যে লোকটাকে দু ঘণ্টা আগেও ফুর্তিবাজ বলে মনে হয়েছিল, তাকে এ রকম ভেঙে পড়তে দেখে অদ্ভুত লাগছিল।
‘ডেডবডি কী হ’ল?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘বম্বে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বম্বেতে ওর ভাইকে কনট্যাক্ট করেছিল–ব্যারিস্টার ভাই; এস এস-এর স্ত্রী নেই। দুবার বিয়ে করেছিল, দুই স্ত্রীই মারা গেছে। প্রথম পক্ষের একটি ছেলে ছিল–সে বছর-চোদ্দ আগে বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। সে অনেক ব্যাপার। এস এস ছেলেকে ভীষণ ভালবাসত, তার অনেক খোঁজ করেছিল, কিন্তু তার আর কোনও পাত্তাই পাওয়া যায়নি। তাই ভাইকেই ইনফর্ম করেছিল। ভাই পোস্টমপ্টেম করতে দেয়নি, তাই বডি তার পরদিন পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
এখানে বলে রাখি—পোস্টমর্টেম কথাটার মানে আমি ফেলুদার কাছেই জেনেছিলাম। কেউ যদি অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনকভাবে মারা যায়, তা হলে পুলিশের তদন্ত হয়, আর তখন পুলিশের ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেয়—কখন মরেছে, কোথায় চাট পেয়ে মরেছে, বিষ খাওয়ানো হয়েছিল কি না—এই সব আর কী? একেই বলে পোস্টমর্টেম।
ফেলুদা বলল, ‘কবে ঘটেছে ব্যাপারটা?’
শশধরবাবু বললেন, ‘ইলেভন্থ সকালে। সাতুই ও এখানে এসে পৌঁছেছিল।’ তারপর আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমি তো এখনও বিশ্বাসই করতে পারছি না!…কার কপালে যে কখন কী ঘটে! তবে আমি থাকলে বোধহয় এ দুর্ঘটনা ঘটত না।’
‘আপনার প্ল্যান কী?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘কী আবার? আর তো এখানে থাকার কোনও মানে হয় না। আমি এখন যাচ্ছি। কাল সকালে যদি একটা ফ্লাইট পাওয়া যায়। তার খোঁজ করতে। চেনাশোনা আছে, হয়ে যাবে বলে মনে হয়৷’
শশধর বাবু উঠে পড়লেন।
‘চলি। যাবার আগে একবার দেখা হবে নিশ্চয়ই। আপনারা আর এ নিয়ে ভাববেন না। হ্যাভ এ গুড টাইম!’
ভদ্রলোক হোটেল থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন। ফেলুদা কিছুক্ষণ চুপ করে ভুরু কুঁচকিয়ে বসে থেকে সকালে অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে শশধর বাবু যে কথাটা বলেছিলেন, সেটাই ফিস ফিস করে দুবার বলল-‘ওয়ান চান্স ইন মিলিয়ন।’ তারপর বলল, ‘অবিশ্যি মাথায় বাজ পড়েও তো লোক মারে। সেটাও কম আশ্চর্য নয়।’
আমি এতক্ষণ লক্ষ করিনি, এখন দেখলাম, আমাদের কাছেই আরেকটা চেয়ারে হোটেলের সেই বাঙালি ভদ্রলোকটি হাতে ‘আনন্দবাজার’ খুলে বসে আছেন। শশধরবাবু চলে যেতেই তিনি কাগজটা ভাঁজ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে ফেলুদাকে নমস্কার করে তার পাশের চেয়ারে বসে বললেন, ‘সিকিমের রাস্তাঘাটে কখন যে কী হয় কিছুই বলা যায় না। এখানে পাথর পড়ে মানুষ মরাটা কিছুই আশ্চর্য না। আপনারা তো আজই এলেন?’
ফেলুদা একটা গভীর হুঁ-এর মতো শব্দ করল। ভদ্রলোক একটা স্টিলের ফ্রেমে হালকা সবুজ রঙের কাচওয়ালা চশমা পরেছিলেন। বয়স বোধহয় ত্রিশ-পঁয়ত্ৰিশের বেশি নয়। ঠোঁট আর নাকের মাঝখানে একটা ছোট্ট চারকোেনা গোঁফ আছে, যেটাকে বোধহয় ‘ব্যাটারফ্লাই’ বলা হয়। আজকাল এ রকম গোঁফ খুব বেশি দেখা যায় না।
‘বেশ অমায়িক লোক ছিলেন মিস্টার শেলভাঙ্কার।’
‘আপনার সঙ্গে পরিচয় ছিল?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘যেটুকু হয়েছিল তাতেই বুঝেছি। সমঝদার লোক-যাকে বলে রসিক আর কী। আর্টের দিকে খুব ঝোঁক। আমার কাছে একটা তিব্বতি মূর্তি ছিল, সেটা উনি কিনলেন মারা যাবার ঠিক দু দিন আগে৷’
‘উনি ওসব জিনিস কালেক্ট করতেন?’
‘কালেক্ট-ফালেক্ট জানি না-আমার সঙ্গে আর্ট এম্পোরিয়ামে আলাপ, দেখি এটা-সেটা ঘেঁটেঘুটে দেখছেন। বললুম, আমার কাছে একটা পুরনো তিব্বতি মূর্তি আছে, তুমি দেখবে? তা বললে, ডাকবাংলোয় নিয়ে এসে। গেলুম নিয়ে, দেখালুম। ভদ্রলোক অন দি স্পট কিনে নিলেন। অবিশ্যি জিনিসটাও ছিল খুব ডিসেন্ট। আমার ঠাকুরদা তিব্বত থেকে এনেছিলেন। নটা মাথা, চৌত্ৰিশটা হাত৷’
‘অই সি।‘
ফেলুদা গভীর ভাব দেখালেও, আমার কিন্তু ভদ্রলোককে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছিল, বিশেষ করে ওর হাসিটা, যেটা ওর ঠোঁটের কোণে লেগেই আছে! শেলভাঙ্কারের মৃত্যুটাও যেন ওর কাছে একটা হাসির ব্যাপার।
‘আমার নাম নিশিকান্ত সরকার।’
ফেলুদা নিজের পরিচয় না দিয়ে কেবল একটা ছোট্ট নমস্কার করল।
ভদ্রলোক বলে চললেন, ‘আমি থাকি দার্জিলিং-এ তিন পুরুষ ধরে আছি আমরা। তবে গায়ের রংটা দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল, তাই না?’
ফেলুদা সামান্য একটু হেসে অভদ্রতা অ্যাভয়েড করল।
‘ও দিকটা, আর কালিম্পংটা থারলি ঘুরে দেখা আছে। সিকিমটা আসা হয়নি। অবিশ্যি সেটা আমার নেগা-মানে নেগলিজেন্স৷ এসে বুঝছি কী মিস করছিলুম; কাছেপিঠে সব অদ্ভুত জায়গা আছে, জানেন তো? নাকি আপনার সব দেখা?’
ফেলুদা বলল যে সেও নতুন, আজই প্রথম সিকিমের মাটিতে পদার্পণ।
‘বাঃ!’ ভদ্রলোকের এবার প্রায় ছাব্বিশ পাটি দাঁত দেখা গেল। ক’দিন আছেন তো? বেশ ঘুরে-টুরে দেখা যাকে৷’
‘ইচ্ছে তো আছে।’
‘পোমিয়াংচিটা শুনিচি দারুণ জায়গা৷’
‘যেখানে সিকিমের পুরনো রাজধানীর ভগ্নাবশেষ আছে?’
‘শুধু রাজধানী কেন? গাইডবুকটা দেখুন না। ফরেস্ট আছে, ব্রিটিশ আমলের ডাকবাংলো আছে, প্রাচীন গুম্ফা আছে, কাঞ্চনজঙ্ঘার ফাস্টক্লাস ভিউ আছে।–আর কত চাই?’
‘সুযোগ হলে নিশ্চয়ই যাব৷’ বলে ফেলুদা উঠে পড়ল।
‘উঠছেন?’
ফেলুদা বলল, ‘যাই, একটু ঘুরে দেখে আসি। এখানে কি বেরোবার সময় ঘরের দরজা-টরজা বন্ধ করে যেতে হয় নাকি?’