ফেলুদা বলল, ‘সেদিন শেলভাঙ্কার যখন গুম্ফাটা দেখতে যান, উনি কি একই যান?’
‘সেটা বলতে পারি না। আমি তো অনেক সকলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। অবিশ্যি ডক্টর বৈদ্য তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে গাড়িতে উঠে থাকতে পারেন। সন্দেহ বাতিকটা বাবার একেবারেই ছিল না। এমনিতে অত্যন্ত সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি৷’
ফেলুদা বিছানা ছেড়ে উঠে গভীরভাবে কিছুক্ষণ পায়চারি করে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে পেমিয়াংচি যাবে?’
হেলমুট দৃঢ়স্বরে বলল, ‘বাবাকে যে খুন করেছে, তার হাতে হাতকড়া পরানোর জন্য আমি যে-কোনও জায়গায় যেতে প্ৰস্তুত আছি।’
‘এখান থেকে কত দূর জানো জায়গাটা?’
‘একশো মাইলের কাছাকাছি বলে শুনেছি। হয়তো সামান্য বেশিও হতে পারে।’
‘তার মানে ছ-সাত ঘণ্টা ধাক্কা৷’
‘রাস্তা খারাপ না হলে আরও তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যেতে পারে। আমার মতে আজই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পড়া উচিত।’
ফেলুদা বলল, ‘আমারও তাই মত। আমি একটা জিপের ব্যবস্থা দেখছি। জিনিসপত্র সঙ্গে বেশি না নেওয়াই ভাল।’
‘তুমি জিপ দেখো, আমি ডাকবাংলোর বুকিংটা সেরে রাখছি। বাই দ্য ওয়ে—’ হেলমুট ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে থেমে ফেলুদার দিকে ঘুরে বলল, ‘লোকটা যে-পরিমাণে ডেঞ্জারাস বলে মনে হচ্ছে, ওর কাছে বন্দুক-টন্দুক থাকা কিছুই আশ্চর্য নয়। এদিকে আমার কাছে তো ফ্ল্যাশ-গান ছাড়া আর কিছুই নেই! তোমাদের কাছে—‘
হেলমুটের কথা শেষ হবার আগেই ফেলুদা তার সুটকেসের ভিতর হাত ঢুকিয়ে রিভলবারটা বার করে হেলমুটকে দেখিয়ে দিল।
‘আর এই যে আমার কার্ড৷’
ফেলুদা তার ‘প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর’ লেখা ভিজিটিং কার্ডের একটা হেলমুটের দিকে এগিয়ে দিল।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেদিন আর কোনও জিপ ভাড়া পাওয়া গেল না। যে ক’টা ছিল, সবগুলো আমেরিকান টুরিস্টরা নিয়ে সারাদিনের জন্য রুমটেক চলে গেছে। আগামীকাল সকালের জন্য জিপের ব্যবস্থা করে বেশির ভাগ দিনটাই হেঁটে গ্যাংটক শহর দেখে কাটিয়ে দিলাম। দুপুরে বাজারের দিকটায় নিশিকান্তবাবুর সঙ্গে দেখা হল। তাঁকে পেমিয়াংচির কথা বলতে তিনি অবিশ্যি লাফিয়ে উঠলেন।
সন্ধের দিকে ভদ্রলোক একটা অদ্ভুত জিনিস। এনে আমাদের দেখালেন। হাতখনেক লম্বা একটা লাঠি, তার ডগায় বাঁধা ছোট্ট একটা কাপড়ের থলি।
‘কী জিনিস বলুন তো এটা’, একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন নিশিকান্তবাবু। ‘জানেন না তো? এই থলের ভিতর আছে নুন আর তামাকপাত। পায়ে যদি জোঁক ধরে, এই থলির একটা ঘষাতেই বাবাজি খসে পড়বেন।’
ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, ‘নাইলনের মোজা ভেদ করেও জোঁক ঢোকে নাকি?’
‘কিছুই বিশ্বাস নেই মশাই। গেঞ্জি, শার্ট আর ডবল পুলওভার ভেদ করেও বুকের রক্ত খেতে দেখেছি জোঁককে। আর মজা কী জানেন তো? ধরুন, লাইন করে একদল লোক চলেছে জোঁকের জায়গা দিয়ে। এখন, জোঁকের তো চোখ নেই–জোঁক দেখতে পায় না–মাটির ভাইব্রেশনে বুঝতে পারে কোনও প্রাণী আসছে! লাইনের মাথায় যে লোক থাকবে, তাকে জোঁক অ্যাটাক করবে না–কিন্তু তার ভাইব্রেশনে তারা সজাগ হবে। দ্বিতীয় লোকের বেলা তারা মাথা উঁচিয়ে উঠবে, আর থার্ড যিনি রয়েছেন, তাঁর আর নিস্তার নেই–তাঁকে ধরবেই।’
ঠিক হল আমরা প্রত্যেকেই একটা করে জোঁক-ছাড়ানো লাঠি সঙ্গে নিয়ে নেব।
শুতে যাবার আগে ফেলুদা বলল, ‘দুদিন বাদেই বুদ্ধ-পূর্ণিমা—এখানে উৎসব হবে।’
‘সে উৎসব কি আমরা দেখতে পাব? আমি ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
‘জানি না। তবে তার চেয়েও অনেক বড় পুণ্য কাজ হবে। যদি আমরা শেলভাঙ্কিারের হত্যাকারীকে কব্জা করতে পারি।‘
সারারাত আকাশ পরিষ্কার ছিল, আর আমাদের জানালা দিয়ে ত্ৰয়োদশীর চাঁদের আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছিল।
পরদিন ভোর পাঁচটায় আমি, ফেলুদা, হেলমুট আর নিশিকান্ত সরকার সামান্য জিনিসপত্র, চারটে কাগজের বাক্সে হোটেলের তৈরি দুপুরের লাঞ্চ আর চারখানা জোঁক-ছাড়ানো লাঠি নিয়ে দুৰ্গগা বলে পেমিয়াংচির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম।
১১. গ্যাংটক থেকে পেমিয়াংচি
গ্যাংটক থেকে পেমিয়াংচি যাবার দুটো রাস্তা আছে–একটা কিউশিং হয়ে, আরেকটা নামচি দিয়ে নয়াবাজার হয়ে। কিউশিং-এর রাস্তা দিয়ে গেলে দূরটা কম হয়, কিন্তু গত ক’দিনের বৃষ্টিতে সে রাস্তা নাকি খারাপ হয়ে গেছে, তাই আমাদের নয়াবাজার দিয়েই যেতে হবে। একশো সাতাশ মাইল পথ। এমনিতে হয়তো দুপুরের খাওয়াটা সারার জন্য নামচিতে থামতে হত, কিন্তু আমরা হোটেল থেকে লুচি, আলুর তরকারি আর মাংসের কাটলেট নিয়ে নিয়েছি। তা ছাড়া দুটো ফ্লাস্কে রয়েছে জল, আর দুটোতে গরম কফি; কাজেই পথে আর খাওয়ার জন্য থামতে হবে না। সাবধানে গেলেও ঘণ্টা আষ্ট্রেকের বেশি সময় লাগা উচিত নয়। তাই মনে হয়, বিকেলের আগেই আমরা পেমিয়াংচি পৌঁছে যাব। হেলমুট দেখলাম একটার বেশি ক্যামেরা সঙ্গে নেয়নি, আর নিশিকান্তবাবু দেখি কোত্থেকে একজোড়া চামড়ার গোলোস জুতো সঙ্গে নিয়ে নিয়েছেন। বললেন, ‘ভেবে দেখলাম, জোঁক যদি পায়ের পিছন দিকে ধরে, তা হলে তো আর দেখতে পাব না! নুনের থলি কোন কাজটা দেবে মশাই? তার চেয়ে এই গামবুটই ভাল–সেন্ট পারসেন্ট সেফসাইড৷’
‘যদি গাছ থেকে মাথায় পড়ে জোঁক?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
নিশিকান্তবাবু মাথা নাড়লেন। ‘ম্যাক–মানে ম্যাক্সিমাম জোঁকের টাইম এটা নয়। সেটা আরও পরে—জুলাই অগাস্টে। এখন বাবাজিরা সব মাটিতেই থাকেন।’