‘রিমার্কেবল’, ফেলুদা বলে উঠল, ‘অদ্ভুত ছবি। এ রকম ছবি আমি কমই দেখেছি।’
‘এ রকম সুযোগও কমই পাওয়া যায়’, হেলমুট বলল।
‘তুমি ছবিগুলো তোলার পর কী করলে?’
‘গ্যাংটকে ফিরে এলাম। হেঁটেই গিয়েছিলাম–হেঁটেই ফিরলাম। অ্যাক্সিডেন্টের জায়গায় পৌঁছনোর আগেই শেলভাঙ্কারকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি গিয়ে শুধু পাথর আর ভাঙা জিপ দেখেছি। গ্যাংটকে ঢুকতেই অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়েছি, আর পেয়েই সোজা হাসপাতালে চলে গেছি। আমি যাবার পরেও শেলভাঙ্কার ঘণ্টা দু-এক বেঁচে ছিলেন।’
‘তোমার ছবি তোলার ব্যাপারটা তুমি কাউকে বলোনি?’
‘বলে কী লাভ? যতক্ষণ না সে-ছবি প্রিন্ট হয়ে আসছে, ততক্ষণ তো সেটাকে প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। মুখের কথা কে বিশ্বাস করবে! অথচ আমি সেই মুহূর্ত থেকেই জানি ঘটনাটা কীভাবে ঘটেছিল, জানি যে জিনিসটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়, খুন। আরও কাছ থেকে তুললে অবিশ্যি খুনির চেহারাটাও বোঝা যেত। কিন্তু বুঝতেই পারছি সেটা সম্ভব ছিল না।‘
ফেলুদা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলল, ‘ওই লাল পোশাক পরা লোকটা কি তা হলে বীরেন্দ্ৰ?’
‘ইম্পসিবল।’ দৃঢ় গলায় বলে উঠল। হেলমুট।
আমরা দুজনেই রীতিমতো অবাক হয়ে তার দিকে চাইলাম।
‘মানে?’ ফেলুদা বলল।
‘তুমি অত শিওর হচ্ছে কী করে?’
‘কারণ আমিই হচ্ছি বীরেন্দ্ৰ শেলভাঙ্কার।’
ফেলুদার চোখ ছানাবড়া হতে এই প্রথম দেখলাম।
‘তুমি বীরেন্দ্র মানে? তোমার চুল কটা, তোমার চোখ নীল, তোমার ইংরেজিতে জার্মান টান…’
‘ভেরি সিম্পল।’ হেলমুট চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। ‘আমার বাবা দুবার বিয়ে করেন। আমি প্রথম স্ত্রীর সন্তান। আমার মা ছিলেন জার্মান। বাবা যখন হাইডেলবার্গে ছাত্র ছিলেন, তখনই আলাপ, আর বিদেশে থাকতেই বাবা বিয়ে করেন। মা-র নাম ছিল হেল্গা। বিয়ের আগের পদবি ছিল উঙ্গার। আমি যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে জার্মানি গিয়ে সেটল করি, তখন বীরেন্দ্ৰ নামটা ছেড়ে হেলমুট নামটা নিই, আর মা-র পদবিটা নিই।’
আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। সত্যিই তো—জার্মান স্ত্রী হলে ছেলের চেহারা সাহেবের মতো হওয়া কিছুই আশ্চর্য নয়।
‘বড়ি ছেড়ে চলে গেলে কেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘মা মারা যাবার পাঁচ বছর পর বাবা যখন দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেন, তখন মনটা ভেঙে গেল। মাকে আমি ভীষণ ভালবাসতাম। বাবার উপরেও টান ছিল, কিন্তু ঘটনাটার পর মনটা কেমন জানি বিগড়ে গেল। বাবার উপর একটা ঘৃণার ভাব এল মনে। তাই সব ছেড়েছুড়ে চলে গেলাম। বহু কষ্ট করে, বহুবার নিজের জীবন বিপন্ন করে অবশেষে আমি ইউরোপে পৌঁছই। গোড়ায় কয়েক বছর কুলিগিরি থেকে এমন কোনও কাজ নেই যা করিনি। প্রায় সাত-আট বছর এইভাবে কষ্টে কাটে। তারপর ছবি তুলতে শিখি। ভাল ফটোগ্রাফার হিসাবে নামও হয়। অনেক পত্রিকায় আমার তোলা ইউরোপের অনেক দেশের ছবি ছাপা হয়। বছর চারেক আগে ফ্লোরেন্সে ছবি তুলছিলাম, সেখানে হঠাৎ বাবার এক বন্ধুর সামনে পড়ে যাই। তিনি আমাকে চিনে ফেলেন, আর তিনিই বাবাকে আমার সম্বন্ধে লিখে জানান। তারপর বাবা ডিটেকটিভ লাগান আমাকে খুঁজে বার করার জন্য। সেই থেকে দাড়ি রাখতে শুরু করি, আর আমার চোখের মণির রংটাও বদলে ফেলি।’
‘কনট্যাকট লেন্স?’ ফেলুদা বলে উঠল।
হেলমুট একটু হেসে তার দুই চোখের ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে দুটো পাতলা লেন্স খুলে বার করে আমাদের দিকে তাকাল। অবাক হয়ে দেখলাম যে তার চোখ আমাদেরই মতো কালো হয়ে গেছে। পরমুহূর্তেই আবার লেনুস দুটো পরে নিয়ে হেলমুট বলে চলল—
‘বছর খানেক আগে এক হিপির দলের সঙ্গে ভিড়ে ভারতবর্ষে আসি। দেশের উপর থেকে টান আমার কোনওদিনও যায়নি। আমার পিছনে তখনও লোক লেগে ছিল। বাবা অনেক পয়সা খরচ করেছেন এই খোঁজার ব্যাপারে। কাঠমাণ্ডুতে গিয়ে একটা মনাস্টেরিতে ছিলাম। যখন দেখলাম। সেখানেও পিছনে টিকটিকি ঘুরছে, তখন সিকিমে চলে এলাম।’
ফেলুদা বলল, ‘তোমাকে ফিরে পেয়ে তোমার বাবা খুশি হননি?’
‘আমাকে চিনতেই পারেননি! আমি আগের চেয়ে রোগ হয়ে গেছি অনেক। তার উপরে আমার লম্বা চুল, আমার গোঁফ-দাড়ি, আমার চোখের নীল রং—এই সব কারণেই বোধহয় তিনি নিজের ছেলেকে চিনতেই পারলেন না; আমার কাছে বসে তিনি বীরেন্দ্র সম্বন্ধে আক্ষেপ প্ৰকাশ করলেন। ভারতবর্ষে ফিরে আসার আগেই বাবার উপর থেকে আমার বিরূপ ভাবটা অনেকটা চলে গিয়েছিল; বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অনেক জিনিস মেনে নিতে শেখে। কিন্তু যখন দেখলাম তিনি আমাকে চিনলেন না, তখন আর নিজের পরিচয়টা দিলাম না। শেষ পর্যন্ত হয়তো দিতাম, কিন্তু তার আর সুযোগ হল কই?’
‘খুনি কে, এ-সম্বন্ধে তোমার কোনও ধারণা আছে?’
‘ফ্র্যাঙ্কলি বলব?’
‘নিশ্চয়ই।‘
‘আমার মতে ডক্টর বৈদ্যুকে কোনও মতেই পালাতে দেওয়া উচিত নয়।’
ফেলুদা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘আমি এ-ব্যাপারে তোমার সঙ্গে একমত৷’
হেলমুট (নাকি বীরেন্দ্র বলা উচিত?) বলল, ‘ও তো জানে না। আমিই বীরেন্দ্র, তাই ফস করে আমার সামনেই কালকে ওই নামটাই করে দিল। আর যে মুহুর্তে নামটা করল, সেই মুহুর্তেই আমার লোকটা সম্বন্ধে ধারণা সম্পূর্ণ পালটে গেল। আমার মতে লোকটা এক নম্বরের ভণ্ড শয়তান। ও-ই খুন করেছে। এবং ও-ই মূর্তিটা নিয়েছে।’