‘চোদ্দোই। তুমি ভুলে যাচ্ছ ফেলুদা—সেদিন ছিল পয়লা বৈশাখ–‘
‘ইয়েস ইয়েস। আর খুন হয়েছে কবে?’
‘এগারোই।’
‘সেদিন গ্যাংটকে ছিল শেলভাঙ্কার, নিশিকান্ত, হেলমুট আর ডক্টর বৈদ্য।’
‘ধরে নিচ্ছি বীরেন্দ্রও ছিল। ধরে নিচ্ছি প্রাইটেক্স ভুল করেনি। আচ্ছা…নিশিকান্তবাবুর জানালা দিয়ে কবে কাগজ ফেলল?’
‘যেদিন আমরা এসেছি, সেদিনই রাত্রে।’
‘চোদ্দই রাত্রে। গুড। সে সময় কে কে ছিল শহরে?’
‘হেলমুট, শশধর, ধরে নিচ্ছি বীরেন্দ্র, আর…আর…’
‘নিশিকান্ত।’
‘নিশিকান্ত তো থাকবেই।‘
‘শুধু থাকবেই না। ও যদি কোনও গোলমাল করে থাকে, তা হলো নিজের উপর থেকে সন্দেহ হটিয়ে দেবার জন্য নিজেই নিজের ঘরে কাগজ ফেলতে পারে, নিজেই খাদের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে ‘হেলপ বলে চিৎকার করতে পারে৷’
‘কী গোলমাল করতে পারেন নিশিকান্তবাবু?’
‘সেটা এখনও জানি না। খুন করার সাহস ওর আছে বলে মনে হয় না। লোকটা নেহাতই ভিতু, আর সেটা অভিনয় নয়।’
‘তা হলে আর কেউ বাকি রইল কি?’
‘ডক্টর বৈদ্য! ডক্টর বৈদ্যকে বাদ দিবি না। তিনি কবে কালিম্পং গেছেন, বা অ্যাট অল গেছেন কি না–সেটা তো আমরা জানি না। ডাকবাংলো থেকে যে অন্য জায়গায় গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকেননি তার গ্যারান্টি কী?’
ফেলুদা এক চুমুকে এক গেলাস সিকিম অরেঞ্জ শেষ করে বলল, ‘একমাত্র শশধরবাবুর গতিবিধি সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও কারণ নেই–কারণ তিনি আমাদের সঙ্গে একই প্লেনে একই জিপে গ্যাংটক এসেছেন, এবং পরদিন বম্বে ফিরে গেছেন; ফিরে যে গেছেন সেটা তাঁর বাড়ির লোকে টেলিফোনে কনফার্ম করেছে। অবিশ্যি এখন তিনি বম্বেতে নেই। একটা চান্স আছে, হি ইজ অন হিজ ওয়ে হিয়ার। মনে হচ্ছে পেমিয়াংচিটা—’
ফেলুদা কথা থামাল। বাইরে থেকে একজন লোক এসে হোটেলের ভিতর ঢুকে ম্যানেজারের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। লোকটা আমাদের জার্মান হিপি হেলমুট উঙ্গার। ম্যানেজারকে কী জিজ্ঞেস করাতে তিনি আমাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে দিলেন।
‘ওঃ—তোমরা এখানেই আছ? আমি দেখতেই পাইনি।’ আমরা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। হেলমুটের যেন একটু কিন্তু কিন্তু ভাব। বলল, ‘একটা জরুরি আলোচনা ছিল। তোমাদের ঘরে যাওয়া যায় কি?’
১০. ঘরে এসে ঢোকার পর
ঘরে এসে ঢোকার পর হেলমুট বলল, ‘মে আই ক্লোজ দ্য ডোর?’ তারপর নিজেই গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল।
আমার বুকের ভিতরে চিপ টিপ। বিরাট লম্বা লোক—ফেলুদার চেয়েও এক ইঞ্চি বেশি। তার উপর জার্মান। তার উপরে শুনেছি হিপিরা নানারকম নেশা করে। আর বিদেশিদের সঙ্গে বন্দুক-পিস্তল গোছের জিনিস থাকাটা কিছুই আশ্চর্য নয়। যদি কোনও বদ মতলবে এসে থাকে লোকটা?
ফেলুদা হেলমুটের দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল।
‘কোল্ড ড্রিঙ্ক বা চা-কফি কিছু চলবে?’
‘নো, থ্যাঙ্কস।’
হেলমুট কাঁধ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে বিছানার উপর রেখে বগলদাবা করা আগ্ফা কোম্পানির একটা বড় লাল খামের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বলল, ‘তোমাদের কয়েকটা ছবি দেখাতে এনেছি। এগুলো কালার নেগেটিভে তোলা। এখানে প্রিন্ট হয় না, তাই দার্জিলিং-এ পাঠিয়েছিলাম। আজই সকলে এনলার্জমেন্টগুলো হয়ে এসেছে।’
হেলমুট একটা ছবি বার করল।
‘এটা নর্থ সিকিম হাইওয়েতে তোলা! অ্যাক্সিডেন্টটা যেখানে হয়, সেখান থেকে রাস্তাটা পাহাড়ের গা দিয়ে গা দিয়ে একেবারে উলটোদিকের পাহাড়ে চলে গেছে। সরু ফিতের মতো রাস্তাটাকে অ্যাক্সিডেন্টের জায়গা থেকে দেখা যায়। আমি ছবিটা তুলেছি। ওই উলটোদিকের রাস্তা থেকেই। গ্রাম, নদী আর দশ কিলোমিটার দূরে সিকিমের খানিকটা অংশ মিলিয়ে একটা চমৎকার ভিউ পাওয়া যায় ওখান থেকে। কথা ছিল শেলভাঙ্কার গুম্ফা যাবার পথে আমাকে ওখান থেকে তুলে নিয়ে যাবে। কিন্তু তার গাড়ি আমার কাছ অবধি পৌঁছায়নি। ছবি তুলতে তুলতে একটা শব্দ পেয়ে সেদিকে মুখ ঘুরিয়ে আমি এই দৃশ্যটা পাই, যেটা আমি আমার টেলিফটো লেন্স দিয়ে তুলে রাখি।‘
আশ্চর্য ছবি। এত দূর থেকে তোলা সত্ত্বেও মোটামুটি সবই বেশ বোঝা যাচ্ছে। একটা জিপ পাহাড়ের গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তার কিছু উপরে রাস্তায় একটা লোক দাঁড়িয়ে পড়ন্ত জিপটার দিকে দেখছে। এটা বোধহয় ড্রাইভারটা। মুখ চেনার উপায় নেই, কিন্তু সে যে নীল রঙের জামা পরা রয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। এ ছাড়া আর কোনও লোক ছবিটাতে নেই।
এবার হেলমুট আরেকটা ছবি বার করল। এটা আগেরটার কয়েক সেকেন্ড পরে তোলা। এটা আরও অদ্ভুত ছবি। এটার তলার দিকে দেখা যাচ্ছে জিপটা পাহাড়ের গায়ে ভাঙা অবস্থায় কত হয়ে পড়ে আছে। আর ডান পাশে কিছু উপরে একটা ঝোপের পিছনে একটা কালো সুটপরা লোকের খানিকটা অংশ মাটিতে শোওয়া অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। ছবির উপর দিকে রাস্তায় ড্রাইভারটা। এবার কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে পিছন করে মাথা উঁচু করে উপর দিকে দেখছে। ছবির একেবারে উপরের অংশে পাহাড়ের গায়ে এবার আরেকজন নতুন লোককে দেখা যাচ্ছে; তারও মুখ চেনার কোনও উপায় নেই, কিন্তু গায়ের জামার রং লালচে। সে একটা বড় পাথরের পিছনে উপুড় হয়ে রয়েছে।
তৃতীয় ছবিতে লাল পোশাক পরা লোকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না; নীল জামা পরা লোকটা দৌড়ানোর ভঙ্গিতে ছবি থেকে প্রায় বেরিয়ে চলে গেছে; গাড়ি আর কালো স্যুটপরা লোকটা যেমন ছিল তেমনই আছে। আর পাহাড়ের গায়ে যে পাথরটা ছিল, সেটা পড়ে। আছে রাস্তার উপর, একটা গাছের পাশে।