রোপওয়ে দেখতে এত ভাল লাগছিল যে ফেলুদার প্রথম ডাকটা শুনতেই পাইনি। তারপর শুনলাম, ‘অ্যাই তোপসে—এদিকে আয়?’
পাহাড়ের গা বেয়ে খানিক দূরে উঠে গেছে ফেলুদা, আর সেখান থেকে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
আমিও উঠে গেলাম! ফেলুদার পাশে একটা পাথর পড়ে আছে–সাইজে সেটা একটা পাঁচ নম্বরের ফুটবলের মতো।
‘এই পাথরের পাশে দাঁড়া৷’
দাঁড়ালাম। এ রকম বাধ্য অ্যাসিস্ট্যান্ট, কোনও গোয়েন্দা কখনও পেয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
‘আমি যাচ্ছি নীচে! ও দিক থেকে এ দিকে হেঁটে যাব। আমি যখন বলব, তখন তুই পাথরটা ঠেলে নীচের দিকে গড়িয়ে দিবি। যেভাবে রয়েছে পাথরটা, বুঝতেই পারছিস একটা ঠেলা দিলেই ওটা নীচের দিকে গড়িয়ে যাবে। পারবি তো?’
‘জলের মতো সোজা।’
ফেলুদা নীচে নেমে যেদিক দিয়ে এসেছি, সেদিকটায় চলে গেল। তারপর শুনতে পেলাম ওর হাক–‘রেডি?’
আমি চেঁচিয়ে বললাম ‘রেডি’–আর তারপরেই পেলাম ফেলুদার প্যায়ের আওয়াজ।
আমার লাইনে আসার আট-দশ পা আগেই ফেলুদা চেঁচিয়ে উঠল—’গো!’ আমি পাথর ঠেলে দিলাম। ফেলুদা হাঁটা থামাল না। দেখলাম পাথর গড়িয়ে রাস্তায় পৌঁছনোর আগেই ফেলুদা তার অন্তত দশ পা সামনে এগিয়ে চলে গেছে।
‘দাঁড়া!’
ফেলুদা ফিরে এল, সঙ্গে পাথর।
‘এবার তুই নীচে যা! তোকে হাঁটতে হবে। হাঁটা থামাবি না। আমি পাথর ফেলব। যদি দেখিস পাথর তোর দিকে তাগ করে আসছে–হয়তো তোর গায়ে এসে লাগবে–তুই, লাফিয়ে পাশ কাটাতে পারুবি তো?’
‘জলের মতো সহজ।’
এবার আমি হাঁটতে শুরু করলাম—আড়চোখ পাহাড়ের দিকে। ফেলুদা খুব হিসেব করে জিভটিব কামড়ে একটা বিশেষ টাইমে পাথরটাকে মারল ঠেলা। আমি থামলাম না। লাফিয়ে পাশ কাটানোরও দরকার হল না। পাথর আমি পৌঁছনোর আগেই রাস্তায় পড়ে দুটো পাক খেয়ে ডান দিকের পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচের দিকে চলে গেল।
ফেলুদা যেখানে ছিল সেখানেই বসে পড়ল। কী আর করি।–আমিও তার কাছে গিয়ে হাজির হলাম।
‘কী মূর্খ আমি! কী মূখ্য! এই সহজ—‘
ফেলুদার কথা শেষ হল না। একটা শব্দ আমার কানে আসতেই এক ঝলক উপরে তাকিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে আমি ফেলুদাকে তার জায়গা থেকে প্রায় তিন হতে পাশে সরিয়ে আনলাম, আর ঠিক সেই মুহুর্তেই একটা বিরাট পাথরের চাই এক সেকেন্ড আগে যেখানে ফেলুদা ছিল, সেখান দিয়ে গড়িয়ে গিয়ে বুনো লাল ফুলের একটা প্ৰকাণ্ড ঝোপড়াকে তছনছ করে দিয়ে রাস্তায় একবার মাত্র ঠোক্কর দিয়ে পিছনের ঢাল দিয়ে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ফেলুদা ‘জায়গাটা সত্যিই নিরাপদ নয়’ বলে আমার হাত ধরে টেনে একেবারে রাস্তায়। তারপর দুজনে আর টু শব্দটি না করে পা চালিয়ে এক নিশ্বাসে একেবারে তেমাথায় পৌঁছে গেলাম! একটা মিলিটারি লরি আমাদের পাশ কাটিয়ে নাথুলার দিকে চলে গেল। ফেলুদা খালি একবার মৃদুস্বরে বলল, ‘থ্যাঙ্কস, তোপসে।’ তার দিকে চেয়ে দেখি সে গভীর হয়ে গেছে। আমার মনের যে কী অবস্থা সে আর বলে কাজ নেই।
কাছেই একটা ছাউনি দেওয়া বসবার ঘর ছিল। অনেকটা ইডেন গার্ডেনের ব্যান্ডস্ট্যান্ডের মতো দেখতে। আমরা তার ভিতরে গিয়ে বেঞ্চিতে বসে হাঁপা ছাড়লাম। ফেলুদা কপালের ঘাম মুছে বলল—
‘কাউকে দেখতে পেয়েছিলি?’
বললাম, ‘না। অনেক উঁচু থেকে পাথরটা এসেছিল। আমি যখন দেখেছি তখনই তার ভেলোসিটি অনেক।’
ফেলুদা একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাল করে একটা টান দিয়ে বলল, ‘আর টিলেঢালা চলবে না! একটা কুইক এসপার-ওসপার হওয়া দরকার।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু অনেক প্রশ্নের তো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না ফেলুদা।’
‘কে বললে তোকে?’ ফেলুদা খোঁকিয়ে উঠল।’কাল রাত্রে কখন ঘুমিয়েছি জানিস? আড়াইটে। ফেলুমিত্তির ঘোড়ার ঘাস কাটছে না। এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল। যা সন্দেহ করেছিলাম। তাই! পাথর এসে গাড়িতে পড়েনি। ওয়ান ইন এ মিলিয়ন চান্সের উপর নির্ভর করে কেউ খুন করে না। প্ল্যানটা ছিল অন্য, কিন্তু সেটাকে অ্যাক্সিডেন্টের চেহারা দেবার জন্য পাথরটা ফেলা হয়েছিল। মিস্টার শেলভাস্করকে অজ্ঞান করা হয়েছিল। আগেই। তারপর তাকে জিপ সমেত খাদের মধ্যে ফেলা হয়েছিল, তারপর সব শেষে ফেলা হয়েছিল পাথর৷’
‘কিন্তু তা হলে…ড্রাইভারটা যে…’
‘ড্রাইভারকে হাত করা হয়েছিল। এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই, কারণ এ ছাড়া জিনিসটা সম্ভব নয়।’
‘কিম্বা ড্রাইভার তো নিজেই খুন করে থাকতে পারে?’
‘না। কারণ, মোটিভ কী? তার পক্ষে মূর্তিটার কথা জানার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল বলে মনে হয় না।’
ফেলুদা উঠে পড়ল।
‘আমাদের টাগেট হচ্ছে SKM 463৷’
কিন্তু দুঃখের বিষয় SKM 463-এর খোঁজ করে তাকে পাওয়া গেল না। সে গাড়ি কাল রাত্রেই নাকি শিলিগুড়ি চলে গেছে।
‘আসলে কী জানিস, জিপটা নতুন বলে সকলেরই ওটার উপর চোখ। ওটা তাই আর বসে থাকে না।’
‘তা হলে আমরা কী করব?’
‘দাঁড়া, একটু ভাবতে দে। সব গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে।’
জিপ-স্ট্যান্ড থেকে হোটেলে ফিরে এলাম। ডাইনিং রুমে বসে বেয়ারাকে ডেকে কোল্ড ড্রিঙ্কের অর্ডার দিলাম। ফেলুদার চোখ লাল, চুল উসকো-খুসকো, মুঠো করা ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের তেলোতে বার বার ব্যর্থ ঘুষি মারছে।
‘কবে পৌঁছেছি আমরা এখানে?’ সে হঠাৎ প্রশ্ন করল।
‘চোদ্দই এপ্রিল৷’
‘চোদ্দই না পনেরোই?’