পৌনে এগারোটার সময় নিশিকান্তবাবু দরজায় টোকা মেরে ‘গুড নাইট করে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ গল্পের বইটা পড়ার চেষ্টা করলাম। জুল ভার্নের ‘কার্পেথিয়ান কাস্ল’। জানি খুব ইন্টারেস্টিং বই, কিন্তু তাও মন বসল না। কিছুক্ষণ পরে বই বন্ধ করে চোখ বুজলাম। ঘুম আসার আগে পর্যন্ত মাঝে মাঝে চোখ খুলে দেখেছি ফেলুদা তার খাতায় নোট করে চলেছে।।
মনে যত দুশ্চিন্তাই থাকুক না কেন–রাত্রে একবারও ঘুম ভাঙেনি। সকলে যখন উঠেছি, তখন জানালা দিয়ে পাহাড়ের গায়ে রোদ দেখা যাচ্ছে। ফেলুদা ঘরে নেই–বোধহয় স্নান করতে গেছে।
যেখানেই যাক–যাবার আগে তার খাটের উপর একটা সাদা কাগজ অ্যাশ-ষ্ট্রে চাপা দিয়ে রেখে গেছে—বোধহয় আমারই দেখার জন্য।
কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলাম তাতে লেখা রয়েছে।—আমাদের চেনা একটা তিব্বতি কথা–যার মানে হল মৃত্যু।
০৯. আসলে ফেলুদা বাথরুমে যায়নি
আসলে ফেলুদা বাথরুমে যায়নি। ও খুব ভোর থাকতে উঠে নীচে চলে গিয়েছিল একটা টেলিফোন করতে। বম্বেতে ট্রাঙ্ক-কাল। আমি সুসান-টান সেরে নীচে গিয়ে দেখি ফেলুদা টেলিফোনে কথা বলছে। শেষ হলে পর জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার?’ ও বলল, ‘শশধরবাবু বম্বেতে নেই। আজ ভোরেই বেরিয়ে পড়েছেন। বোধহয় এখানেই আসছেন। আমার আগের টেলিগ্রামটাতে হয়তো কাজ হয়েছে।’
চা খেতে খেতে ফেলুদা বলল, ‘আজ একটা এক্সপেরিমেন্ট করব। মনে হচ্ছে একটা ব্যাপারে একটু ছেলেমানুষি করে ফেলেছি। সেটা সত্যি কি না পরীক্ষা করে দেখতে হবে।’
এক্সপেরিমেন্টটা কী সেটা আর আগে থেকে জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না। কোথায় সেটা হবে জিজ্ঞেস করাতে ফেলুদা বলল তার জন্য একটা নিরিবিলি জায়গা চাই। নিরিবিলি ধরা হলে হবে কি না জিজ্ঞেস করাতে ফেলুদা চটে গিয়ে বলল, ‘তোর মুণ্ডু! ঘর তো হোটেলেই রয়েছে। চাই একটা রাস্তা, যেখানে লোকজনের ভিড় নেই। কারণ লোকে দেখে ফেললে ভাববে পাগল। একবার নাথুলা রোডের দিকটায় গিয়ে দেখতে হবে।’
সত্যি বলতে কী, এই দুদিনে গ্যাংটকের একটামাত্র রাস্তা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই দেখা হয়নি। তাই একটু হেঁটে বেড়াবার ছুতো পেয়ে ভালই লাগিছিল।
হোটেল থেকে বেরিয়েই ডক্টর বৈদ্যর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। রোদের বেশ ঝাঁঝ, তাই ভদ্রলোক দেখি সানগ্লাস পরেছেন। বললেন, ‘কোথায় চললেন আপনারা?’
ফেলুদা বলল, ‘শহরটা দেখাই হয়নি। ভাবছিলাম একটু ওপর দিকটায় যাব—প্যালেসের ও দিকে।’
‘আমি যাচ্ছি গাড়ির সন্ধানে; আজ দিনটা ভাল আছে। এ গুড ডে টু মোক দ্যটি ট্রিপটু পেমিয়াংচি। আপনার না এলে কিন্তু একটা খুব ভাল জায়গা মিস করবেন।’
‘যাবার তো ইচ্ছে আছে৷’
‘আমি থাকতে থাকতে চলে আসুন। গ্যাংটক জায়গাটা খুব সুবিধের না। বিশেষ করে আপনার পক্ষে নিরাপদ নয় মোটেই।‘
ভদ্রলোক হাসিমুখে হাত নেড়ে চলে গেলেন।
আমি বললাম, ‘হঠাৎ ওকথাটা বললেন কেন ভদ্রলোক?’
ফেলুদা হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘তুখোড় আছেন বাবাজি। আমি যেমন ওকে সন্দেহ করছি, ও-ও তেমনি উলটে আমাকে সন্দেহ করছে। হয়তো বুঝে ফেলেছে যে আমি একটা গোলমালে জড়িয়ে পড়ছি।’
‘কিন্তু তোমাকে তো সত্যিই হুমকি দিয়ে লিখেছে ফেলুদা। খাটের উপর কাগজটা দেখলাম যে।‘
‘এটা কি নতুন জিনিস হল?’
‘তা অবিশ্যি নয়।’
‘তবে! তোর যদি ধারণা হয়ে থাকে যে, ওই একটা তিব্বতি কথার জন্য আমি তদন্ত বন্ধ করে দেব, তা হলে তুই ফেলুমিত্তিরকে এখনও চিনিসনি৷’
মুখে সেটা না বললেও, মনে মনে বললাম যে যদি কেউ ফেলুমিত্তিরকে চেনে তবে সেটা আমিই। বাদশাহী আংটির ব্যাপারে হুমকি সত্ত্বেও কী সাংঘাতিক বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ফেলুদা সেটা তো আমি দেখেছি।
চড়াই রাস্তাটা উঠে ক্ৰমে ফ্ল্যাট হয়ে গিয়ে শেষটায় একটা প্ৰকাণ্ড চওড়া—প্রায় দাৰ্জিলিং-এর ম্যালের মতো–খোলা জায়গায় এসে পড়েছে। সেটার মাঝখানে একটা নিচু রেলিং দিয়ে ঘেরা ফুলের কেয়ারি করা গোল জায়গা রয়েছে। আবার সেটার মাঝখানে একটা হলদে কাঠের পোস্টে এদিকে-ওদিকে পয়েন্ট করা সব রাস্তা আর জায়গার নাম লেখা ফলক রয়েছে। ডান দিকে যে ফলকটা পয়েন্ট করা, তাতে লেখা রয়েছে ‘প্যালেস’। ডান দিকে চেয়ে দেখলাম, দুদিকে গাছের সারিওয়ালা একটা সোজা রাস্তার শেষ মাথায় একটা বাহারের গেট দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম ওটাই হল প্যালেসের গেট।
বাঁ দিকে দেখানো ফলকটায় লেখা রয়েছে ‘নাথুলা রোড।’ আশেপাশে কোনও লোকজন নেই। দূরে প্যালেসের রাস্তায় কালকের দেখা বিদেশি টুরিস্টরা ক্যামেরা হাতে পায়চারি করছে। ফেলুদা বলল, ‘লক্ষণ ভালই। চ’ বাঁ দিকে চ’।‘
যে নাথুলা রোড দিয়ে একেবারে বডক্টরে চলে যাওয়া যায়, সেটা দিয়ে আমি আর ফেলুদা এগিয়ে চললাম এক্সপেরিমেন্টের উদ্দেশ্যে। রাস্তাটা ক্ৰমেই নির্জন হয়ে এসেছে। ফেলুদা বাঁ দিকের খাড়াই পাহাড়ের দিকে দৃষ্টি রেখে এগিয়ে চলেছে। এদিকটা শহরের পুব দিক। কাঞ্চনজঙ্ঘা হল পশ্চিম দিকে। এ দিকে বরফ দেখা যায় না, তবে নীচে বহু দূরে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা নদী দেখা যায়। আরেকটা জিনিস যেটা দেখা যায় সেটা হল রোপওয়ে। শূন্যে টাঙানো তারের রাস্তা দিয়ে ঝুলন্ত গাড়ি চলেছে মাল নিয়ে পাহাড়ের এ-মাথার এক স্টেশন থেকে ও-মাথার আরেক স্টেশনে।