বাগডোগরা এয়ারপোর্টে এসে প্লেন নামলি ঠিক সাড়ে সাতটায়। কলকাতা থেকেই বাবা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন যাতে আমাদের জন্য এখানে একটা জিপ মজুত থাকে। আমরা সটান জিপে না উঠে আগে এয়ারপোর্টের রেস্টোরান্টে গিয়ে বেশ ভাল করে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম; কারণ এখান থেকে গ্যাংটক যেতে লাগবে প্রায় ছ-সাত ঘণ্টা। রাস্তা খারাপ থাকলে আরও বেশি লাগতে পারে। তবে ভরসা এই যে আজি সবে চোদ্দই এপ্রিল; মনে হয় এখনও তেমন বর্ষা নামেনি।
অমলেটটা শেষ করে মাছ ভাজা ধরেছি, এমন সময় দেখি প্লেনের সেই ভদ্রলোকটি একটা কোনার টেবিল থেকে উঠে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে আমাদেরই দিকে হাসিমুখে এগিয়ে আসছেন।
‘আপনারা কি ড্যাং, না ক্যাং, না গ্যাং?
আমি তো প্রশ্ন শুনে ঘাবড়েই গেলাম। এ আবার কী হেঁয়ালিতে কথা বলছেন। ভদ্রলোক? কিন্তু ফেলুদা তৎক্ষণাৎ হেসে উত্তর দিল ‘গ্যাং।’
গ্যাং শুনে ভদ্রলোক বললেন, ‘জিপের ব্যবস্থা আছে? মানে, সোজা কথা–আপনাদের সঙ্গে শেয়ারে লটকে পড়তে পারি কি?’
ফেলুদা বলল, ‘স্বচ্ছন্দে, আর আমিও বুঝে ফেললাম যে ড্যাং হচ্ছে দাৰ্জিলিং, ক্যাং কালিম্পং আর গ্যাং গ্যাংটক।
ভদ্রলোক বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ। আমার নাম শশধর বোস৷’
‘কী ব্যাপার?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন। ‘হলিডে?’
‘তা ছাড়া আর কী!’
‘আই লাভ গ্যাংটক। আগে গেছেন কখনও?
‘আজ্ঞে না।‘
‘কোথায় উঠছেন?’
ফেলুদা বেয়ারাকে ডেকে বিল আনার কথা বলে দিয়ে ভদ্রলোককে একটি চারমিনার অফার করে নিজে একটা ধরিয়ে বলল, ‘একটা হোটেলে ঘর বুক করা আছে। নাম বোধ হয় স্নো-ভিউ৷’
শশধরবাবু বললেন, ‘গ্যাংটকের নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা। শুধু গ্যাংটক কেন—সারা সিকিম চষে বেড়িয়েছি। লাচেন, লচুং, নামচে, নাথুলা—কিছুই বাদ নেই। গ্লোরিয়াস! যেমন দৃশ্য, তেমনি শান্তি। পাহাড় চান পাহাড়, অৰ্কিড চান অর্কিড–রোদ চান, মেঘ চান, বৃষ্টি চান, মিস্ট চান—সব পাবেন। তিস্তা, রঙ্গিত—নদীগুলোর কোনও তুলনা নেই। তবে গণ্ডগোল হল রাস্তা নিয়ে—রোডস্—বুঝেছেন। আসলে এ দিকের পাহাড়গুলো, যাকে বলে গ্রোইং মাউনটেনস। এখনও বাড়ছে। তাই একটু অস্থির, বুঝেছেন—আর কাঁচা। ইয়াং বয়সে যা হয়। আর কী–হে হে!’
‘তার ফলেই বুঝি ল্যান্ডস্লাইড হয়?’
‘ইয়েস, আর সে বড় বেয়াড়া ব্যাপার। যাচ্ছেন যাচ্ছেন, হঠাৎ দেখলেন সামনে রাস্তা বন্ধ–ধ্বসে গেছে। তার মানে ব্লাস্টিং, পাথর ভাঙো, দেয়াল তোলো, মাটি ফেলো–সে অনেক ঝক্কি। তাও আমি আছে বলে রক্ষে, চটপট সরিয়ে নেয়। তবে এখনও বৃষ্টিটা তেমন নামেনি, তাই খুব একটা গোলমাল হবে বলে মনে হয় না। যাক–আপনাদের পেয়ে খুব আনন্দ হল, সুবিধেও হল। এক এক এতখানি পথ যেতে হবে ভাবতে বিশ্ৰী লাগছিল। কম্পানি পেলে গপ্লেটপ্লে করে সময়টা কেটে যায়।’
ফেলুদা বলল, ‘আপনিও কি চেঞ্জে যাচ্ছেন?’
‘আরো না মশাই!’ ভদ্রলোক হেসে উঠলেন। ‘আমি যাচ্ছি। কাজে। তবে সে এক পিকিউলিয়ার কাজ। অ্যারোম্যাটিক প্লান্টস জানেন?’
‘আপনার বুঝি পারফিউমারির ব্যবসা?’
‘ঠিক ধরেছেন। কেমিক্যাল ফার্ম। তার অনেক কাজের একটা হচ্ছে এসেন্স তৈরি করা। সিকিমে কিছু আমাদের প্রয়োজনীয় গাছ আছে সেটা জানি। সেগুলো সংগ্ৰহ করতেই যাওয়া। আমার পার্টনার আগেই গেছে–দিন সাতেক হল। গাছপালা সম্বন্ধে অগাধ জ্ঞান–বটানিতে ডিগ্রি আছে। আমারও ওর সঙ্গে যাবার কথা ছিল–শেষটায় এক ভাগনের বিয়ের ব্যাপারে ঘাটশিলা চলে যেতে হল। কাল রাত্ৰেই কলকাতা ফিরেছি।’
বিল দেওয়া হয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা উঠে পড়লাম। মালপত্র তুলে নিয়ে জিপের দিকে যেতে যেতে ফেলুদা বলল, ‘আপনাদের কোম্পানিটা কোথায়?’
শশধরবাবু বললেন, ‘বম্বে। কোম্পানি প্রায় বিশ বছর হতে চলল। আমি জয়েন করেছি বছর সাতেক। এস্ এস্ কেমিক্যালস। শিবকুমার শেলভাঙ্কার–ওর নামেই নাম।’
বাগডোগরা থেকে শিলিগুড়ি হয়ে সেবক রোড। সেবক রোড থেকে ডান দিকে তিস্তা নদীকে রেখে রাস্তা চড়াই উঠতে আরম্ভ করে। তারপর মাঝে মাঝে নীচেও নামে, দাৰ্জিলিং-এর মতো সমানে চড়াই ওঠে না। রংপো-তে গিয়ে পশ্চিমবাংলার শেষ আর সিকিমের শুরু।
তিস্তার ধারেই তিস্তা বাজার বলে একটা জায়গা আছে, যেখানে একটা প্ৰকাণ্ড ব্রিজের উপর দিয়ে নদী পেরিয়ে উলটোদিকের পাহাড়ের রাস্তা ধরতে হয়। তিস্তা বাজারে আমাদের জিপ থামানো হল। রোদ থাকার ফলে বেশ গরম লাগছিল, তাই শশধর বাবু বললেন, ‘কোকা-কোলা খাবেন? এ জায়গাটা নাকি দুবছর আগে তিস্তার বন্যায় একেবারে ভেসে গিয়েছিল। দোকানপাট ঘরবাড়ি যা দেখছি, সবই নাকি নতুন তৈরি হয়েছে। দেখেও তাই মনে হয়। ব্রিজটাও নতুন; আগেরটা জলের তোড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।
শশধরবাবু দেখলাম পর পর দু বোতল কোকা-কোলা সাবাড়ি করে দিলেন। সেই সঙ্গে অবিশ্যি আমাদেরও খাওয়ালেন। মনে মনে ভাবলাম–গ্যাংটকে আশা করি কোন্ড ড্রিঙ্ক খেয়ে শরীর ঠাণ্ডা রাখতে হবে না। পাঁচ হাজার ফুট হাইট যখন, নিশ্চয়ই এখানের চেয়ে অনেক বেশি ঠাণ্ডা হবে।
‘কোক’ খাওয়া সেরে যখন দোকানে বোতলগুলো ফেরত দিচ্ছি, তখন লক্ষ করলাম কিছু দূরেই একটা জিপের পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন লোক (তার মধ্যে দুজন মিলিটারিও আছে) হাতটাত নেড়ে বেশ উত্তেজিতভাবে কী জানি আলোচনা করছে। জিপটা উলটোদিক থেকে এসেছে—বোধ হয় শিলিগুড়িই যাবে। ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ কথাটা হঠাৎ কানে আসাতে আমরা তিনজনেই জিপটার দিকে এগিয়ে গেলাম, আর গিয়ে যা শুনলাম, সে এক বিশ্ৰী ব্যাপার। ও দিকে বৃষ্টি না হলেও, গ্যাংটকে নাকি দিন-সাতেক আগে বেশ বৃষ্টি হয়েছে, আর তার ফলে পাহাড় থেকে একটা পাথর গড়িয়ে একটা জিপের উপর পড়ে একজন লোক নাকি মারা গেছে। জিপটাও নাকি রাস্তা থেকে গড়িয়ে প্রায় পাঁচশো ফুট নীচে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। যে মরেছে, তার নাম-ধাম এরা কেউ বলতে পারল না, কারণ এরা কেউ গ্যাংটক থেকে আসছে না।