‘তোমরা সবাই একদৃষ্টি মোমবাতির শিখার দিকে চেয়ে শেলভাঙ্কারের মৃত্যুর কথা চিন্তা করো।’,
স্বপ্নে বাতাস ঢোকার কোনও রাস্তা নেই, তাই মোমবাতির শিখা একেবারে স্থিরভাবে জুলছে। অল্প অল্প করে মোম গলে বাতির গা বেয়ে গড়িয়ে বেতের বুনুনির ওপর জমা হচ্ছে? একটা ফড়িং জাতীয় পোক ঘরের ভিতরে ছিল, সেটা বাতির শিখার চারিদিকে পাক খেতে আরম্ভ করল।
কতক্ষণ যে এইভাবে বাতির দিকে চেয়েছিলাম জানি না। সত্যি বলতে কী, দু-একবার যে আড়াচোখে ডক্টর বৈদ্যর দিকে চেয়ে দেখিনি তা নয়-কিন্তু সেটা তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারেননি, কারণ তাঁর চোখ বন্ধ।
হঠাৎ—যেন অনেক দূর থেকে গলার স্বর আসছে—এইভাবে চিঁ চিঁ করে ডক্টর বৈদ্যর মুখ থেকে কথা বেরোল–‘হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু নো?’
ফেলুদা বলল, ‘শেলভাঙ্কার কি অ্যাক্সিডেন্টে মরেছিল?’
আবার সেই চিঁ চিঁ গলায় উত্তর এল-‘নো৷’
‘তা হলে কীভাবে মরেছিলেন তিনি?’
কিছুক্ষণ সব চুপ। এখন আমরা সবাই মোমবাতি ছেড়ে ডক্টর বৈদ্যর মুখের দিকে চেয়ে আছি। তাঁর চোখ বন্ধ, মাথা পিছন দিকে হেলানো! হেলমুট দেখলাম তার নীল নিম্পলক চোখে ডক্টর বৈদ্যকে দেখছে। নিশিকান্তবাবুর কুতকুতে চোখও তাঁরই দিকে।
ঘরে হঠাৎ এক ঝলক নীল আলো। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
এবার আরও পরিষ্কার গলায় উত্তর এল— ‘মার্ডার।’
‘মার্ডার!’ এটা নিশিকান্তর গলা—শুকিয়ে খসখসে হয়ে গেছে। কথাটা একটানা পারলেন না। তিনি বললেন, ‘মা-হা-হারা-ডার!’
‘কে খুন করেছিল বলা সম্ভব কি?’ আবার ফেলুদাই প্রশ্ন করল।
আমার বুকের ভিতরে অসম্ভব টিপটিপানি আরম্ভ হয়েছে। নিশিকান্তবাবুর মতো আমারও গলা শুকিয়ে এসেছে। নেহাত কথা বলতে হচ্ছে না বলে, না হলে আমিও ধরা পড়ে যেতম।
আবার কিছুক্ষণের জন্য সব চুপ। ফেলুদা দেখলাম একদৃষ্টি ডক্টর বৈদ্যর হাতের দিকে দেখছে। ভদ্রলোক কয়েকবার খুব জোরে জোরে—যেন বেশ কষ্ট করে—নিশ্বাস নিলেন। তারপর উত্তর এল—’বীরেন্দ্ৰ৷’
বীরেন্দ্ৰ? সে আবার কে?
ফেলুদাও নিশ্চয়ই এটা জানতে চাইত, কিন্তু ডক্টর বৈদ্য হঠাৎ তাঁর হাত দুটো টেবিলের উপর থেকে তুলে নিয়ে চোখ খুলে বললেন, ‘এ গ্লাস অফ ওয়াটার প্লিজ।’
হেলমুট মোড়া থেকে উঠে গিয়ে তার টেবিলের উপর রাখা ফ্লাস্ক থেকে গেলাসে জল ঢেলে বৈদ্যুকে দিল। ভদ্রলোকের জল খাওয়া শেষ হলে পর ফেলুদা বলল, ‘বীরেন্দ্ৰ যে কে, সেটা বোধহয় জানার কোনও সম্ভাবনা নেই?’
উত্তর এল হেলমুটের কাছ থেকে।
‘বীরেন্দ্র মিস্টার শেলভাঙ্কারের ছেলের নাম। আমাকে বীরেন্দ্রর কথা বলেছেন তিনি। একবার নয়—অনেকবার।’
জানালা খুলে দিতে গিয়ে দেখি, বাইরে ইলেকট্রিকের আলো দেখা যাচ্ছে। হেলমুটও বোধহয় দেখেছিল, কারণ ও সুইচ টিপে দিল, আর ঘরের বাতি জ্বলে উঠল। ঘড়িতে দেখি পৌনে সাতটা। আমরা সকলেই উঠে পড়লাম।
ডক্টর বৈদ্য নিশিকান্তবাবুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘আপনাকে খুব নার্ভাস লোক বলে মনে হচ্ছে।’
নিশিকান্তবাবু একটু হেঁ হেঁ করলেন।
‘যাক্ গে’ ডক্টর বৈদ্য বললেন, ‘মনে হয় আপনার ফাঁড়া কেটে গেছে।’
‘ওঃ!’ আহ্লাদে হাফ ছেড়ে নিশিকান্তবাবু তাঁর সব ক’টা দাঁত বার করে দিলেন।
ফেলুদা বলল, ‘আপনি ক’ দিন আছেন?’
ডক্টর বৈদ্য বললেন, ‘কাল দিনটা ভাল থাকলে পেমিয়াংচি যাবার ইচ্ছে আছে। ওখানকার মনাস্টেরিতে অনেক পুঁথিপত্র আছে শুনেছি।’
‘আপনি কি তিব্বত নিয়ে পড়াশুনা করছেন?’
‘প্ৰাচীন সভ্যতা বলতে তো ওই একটি বাকি আছে। মিশর, ইরাক, মেসোপটেমিয়া—এ সব তো বহুকাল আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভারতবর্ষে কী আছে বলুন—সবই পাঁচমেশালি। যা ছিল তিব্বতেই ছিল—একেবারে খাঁটি অবস্থায়—এই সেদিনও পর্যন্ত। এখন তো আর তিব্বতে যাবার কোনও মানে হয় না। সৌভাগ্যক্রমে এই সিকিমের মঠগুলোতে সেই পুরনো সভ্যতার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়।’
আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম। রাত্রে নিঘাত বৃষ্টি হবে। আকাশ কালো, আর মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক।
ডক্টর বৈদ্য বললেন, ‘আপনারাও এসে পড়ুন না পেমিয়াংচি।’
ফেলুদা বলল, ‘ঠিক কালই যেতে পারব বলে মনে হয় না। আপনি তো কয়েক দিন থাকবেন ওখানে?’
‘অন্তত দিন চারেক থাকার ইচ্ছে আছে৷’
‘তা হলো হয়তো দেখা হতে পারে, কারণ পোমিয়াংচির কথা অনেকেই বলছে!‘
‘গেলে কিছু নুন সঙ্গে নিতে ভুলবেন না।’ ডক্টর বৈদ্যু হেসে বললেন।
‘নুন?’
‘জোঁক ছাড়াতে হলে নুন ছাড়া গতি নেই।’
০৮. আমাদের হোটেলের রান্না
আমাদের হোটেলটা অন্যদিক দিয়ে খুব একটা কিছু না হলেও, রান্নাটা এখানে বেশ ভালই হয়-বিশেষ করে পাঁঠার মাংসের ঝোল। আমি আর ফেলুদা দুজনেই রাত্রে রুটি খাই, আর নিশিকান্তবাবু দুবেলাই খান ভাত। আজ তিনজনে এক সঙ্গে খেতে বসেছি। নিশিকান্তবাবু একটা নলি-হাড় চুষে চোঁ করে ম্যারো বার করে খেতে খেতে বললেন, ‘ডিসেন্ট লোক মশাই৷’
‘ডক্টর বৈদ্যর কথা বলছেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘আশ্চর্য ক্ষমতা। কী রকম সব বলে-বলে দিলে৷’
ফেলুদা হেসে ঠাট্টার সুরে বলল, ‘আপনার তো ভাল লাগবেই—বলেছে ফাঁড়া কেটে গেছে।–আর কী চাই।’
‘আপনার বুঝি ওঁর কথাগুলো বিশ্বাস হয় না?’
‘কথাগুলো যদি ফলে যায় তা হলে হবে নিশ্চয়ই। এখনও তো সে স্টেজে পৌঁছয়নি। এমনিতে এ সব লোকের উপর চট করে শ্রদ্ধা হওয়া কঠিন। এত বুজরুকের দল আছে। এ লাইনে।’