‘সেন্ট পারসেন্ট। কী সাং—মানে সাংঘাতিক ব্যাপার বলুন তো! নেহাত হাতের কাছে একটা গাছ পেলুম বলে–নইলে তিব্বতি শাসনি তো, মানে, অক্ষরে অক্ষরে—‘
‘লোকটাকে দেখেছেন?’
‘পেছন দিক থেকে এসে ধাক্কা মারলে আবার দেখা যায় নাকি–হেঃ!’
এই দুর্ঘটনার পর রুমটেকে থাকার আর কোনও মনে হয় না–হয়তো নিরাপদও নয়–তাই আমরা আবার বাড়িমুখে রওনা দিলাম। হেলমুটের একটু আপশোস হল, কারণ ও বলল, ছবি তোলার এত ভাল সাবজেক্ট ও এসে অবধি আর পায়নি। তবে নাচ আগামীকালও হবে, তাই ইচ্ছে করলে আরেকবার আসতে পারে।
ফেলুদা অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল—বোধহয় চিন্তা করছিল—কারণ ঘটনা এত দ্রুত ঘটে চলেছে, ওর মতো পরিষ্কার মাথাও হয়তো গুলিয়ে আসছিল। এবার সে নিশিকান্তবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মশাই, আপনার একটা দায়িত্ব আছে সেটা বোধহয় বেশ ভাল করেই বুঝতে পারছেন৷’
‘দায়িত্ব?’ ভদ্রলোকের গলা দিয়ে যেন পুরো আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
‘আপনি কার পিছনে লেগেছেন সেটা না বললে তো কে আপনার পিছনে লেগেছে সেটা বলা যাবে না।
নিশিকান্তবাবু ঢোক গিলে দু হাত তুলে কান মলে বললেন, ‘কী সাক্ষী করে বলতে হবে বলুন—আমি বলছি।–জ্ঞানত আমি কোনও লোকের কোনও অনিষ্ট করিনি—কারুর পিছনে লাগিনি—এমনকী কারুর বদনাম পর্যন্ত করিনি।‘
‘আপনার কোনও যমজ ভাই-টাই নেই তো?’
‘আজ্ঞে না স্যার। আই অ্যাম ওনলি অফ্স্প্রিং।’
‘হুঁ…। মিথ্যে বললে অবিশ্যি আপনিই ঠকবেন। কাজেই ধরে নিচ্ছি। আপনি সত্যি কথাই বলছেন। কিন্তু…’
ফেলুদা চুপ করে গেল। আর সেই যে চুপ করল, সে একেবারে ডাকবাংলো পর্যন্ত। ডাকবাংলোতে এসে হেলমুট গাড়ি থেকে নেমে জিপের ভাড়ার শেয়ার দিতে যাওয়াতে ফেলুদা বাধা দিল–‘তোমাকে তো আমরাই ইনভাইট করেছি, আর তুমি আমাদের দেশে অতিথি–কাজেই তোমার পয়সা তো আমরা নেব না।’
‘অল রাইট’–হেলমুট হেসে বলল, ‘তা হলে একটু বসে চ খেয়ে যাও।’
নিশিকান্তবাবুরও আপত্তি নেই দেখে আমরা তিনজনেই জিপটাকে পাওনা চুকিয়ে ছেড়ে দিয়ে বাংলোয় হেলমুটের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম।
তিনজনে চেয়ারে বসেছি। হেলমুট ঘাড় থেকে ক্যামেরা নামিয়ে টেবিলের উপর রেখে চায়ের অডার দিতে যাবে, এমন সময় একটা আওয়াজ পেয়ে দরজার দিকে চেয়ে দেখি একজন অদ্ভুত দেখতে ভদ্রলোক বাইরে দাঁড়িয়ে হেলমুটের দিকে চেয়ে হেসে ‘হ্যালো’ বললেন। ভদ্রলোকের মুখে কাঁচা-পাক চাপ দাড়ি, মাথাত কাঁচা-পাকা চুল প্রায় কাঁধ অবধি নেমেছে, গাতের উপর দিকে একটা গলাবন্ধ ঢলঢলে অরেঞ্জ রঙের সিকিম জ্যাকেট, আর তলার দিকে ঢিলে ফ্ল্যানেলের পাতলুন। তার হাতে একটা বেশ বড় হলদে লাঠিও রয়েছে–যাকে বোধহয় বলে যষ্ঠি।
হেলমুট আমাদের দিকে ফিরে বলল, ‘পরিচয় করিয়ে দিই-ইনিই ডক্টর বৈদ্য।’
০৭. বঙ্গালি মনে হতেছে
‘আপনাদের দেখিয়ে বঙ্গালি মনে হতেছে।’
ডাক্তার বৈদ্য ঠিক আমার পাশের চেয়ারটায় বসলেন।
ফেলুদা বলল, ‘ঠিকই বলেছেন। … আপনার কথা আমরা আগেই হেলমুটের কাছে শুনেছি।’
‘হেলমুট ইজ এ নাইস বয়৷’
ভদ্রলোক ইংরেজি বাংলা হিন্দি তিনরকম ভাষা মিশিয়ে কথা বলে গেলেন।
‘তবে হেলমুটকে আমি বলেছি যে এদেশের একটা সংস্কারের কথা ও যেন না ভোলে। এরা বিশ্বাস করে যে যার যত বেশি ছবি তোলা হবে, তার তত বেশি আয়ু কমে যাবে। কারণ, এই যে আমি, এই আমার খানিকটা যদি অন্য কোনও বস্তুতেও থেকে থাকে, তার মানে আমার ভাইর্টাল ফোর্সের খানিকটাও নিশ্চয়ই সেই অন্য বস্তুর মধ্যে রয়েছে। এবং সেই পরিমাণে আমার নিজের ভাইটিাল ফোর্সও নিশ্চয়ই কমে যাচ্ছে।’
‘আপনিও কি এতে বিশ্বাস করেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘করলেই বা কী?’ ডক্টর বৈদ্য হেসে বললেন। ‘হেলমুট কি আর আমার ছবি তুলতে বাদ রেখেছে? তবে কোনও জিনিস পরীক্ষা করে দেখার আগে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটা ওঠে। না। এখনও অনেক জিনিস শিখতে বাকি আছে, অনেক কিছু জানতে হবে, অনেক পরীক্ষা করতে হবে।’
ফেলুদা বলল, ‘কিন্তু আপনি তো সে সব না করেই অনেক দূর অগ্রসর হয়েছেন বলে মনে হয়। শুনলাম। আপনি ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন, মৃত ব্যক্তির আত্মার সঙ্গে কথাবাতা বলতে পারেন।’
‘সব সময় না!’ বৈদ্য একটু মুচকি হাসলেন। ‘পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর অনেকটা নির্ভর করে। কিছু জিনিস খুব সহজে বলে দেওয়া যায়। যেমন—‘ বৈদ্য নিশিকান্তবাবুর দিকে আঙুল দেখালেন—‘ওই ভদ্রলোকটি কোনও কারণে অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় ভুগছেন৷’
নিশিকান্তবাবু জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটলেন।
ফেলুদা বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। ওকে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি মৃত্যুভয় দেখাচ্ছেন। সেটা কে বলতে পারেন?’
ডক্টর বৈদ্য কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করলেন। তারপর চোখ খুলে জানালা দিয়ে বাইরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এজেন্ট।’
‘এজেন্ট?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ, এজেন্ট। মানুষ অন্যায় করলে তার শাস্তি হবেই। অনেক সময় ভগবান নিজেই শাস্তি দেন, আবার অনেক সময় তাঁর এজেন্টরা এই কাজটা করে।’
নিশিকান্তবাবু হঠাৎ কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, ‘দ্যাট ইজ অল। আমি আর শুনতে চাই না।‘
বৈদ্য হেসে বললেন, ‘আমি জোর করে কাউকে কিছু শোনাই না। ইনি জিজ্ঞেস করলেন, তাই বললাম। স্বেচ্ছায় লব্ধ জ্ঞান ছাড়া অন্য কোনও জ্ঞানের কোনও মূল্য নেই। তবে একটা কথা বলতে চাই-বাঁচতে হলে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে৷’