ফেলুদা এবার নেড়া জায়গাটোৱ পাশে ঘাসের উপর বসে পড়ে বলল, ‘পাথরটা কীভাবে পড়েছিল জানিস?’
‘কীভাবে?’ আমি ফেলুদার দিকে এগিয়ে গেলাম।
‘এই দ্যাখ।‘
ফেলুদা নেড়া অংশটার একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখাল। আমি ঝুকে পড়ে দেখলাম সেখানে একটা ছোট্ট গর্ত রয়েছে। সাপের গর্ত নাকি?
‘যদ্দূর মনে হয়, ফেলুদা বলে চলল, ‘প্রায় পঁচাত্তর পার্সেন্ট সিওর হয়ে বলা চলে যে একটা লম্বা লোহার ডান্ডা বা ওই জাতীয় একটা কিছু মাটিতে ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে পাথরটাকে ফেলা হয়েছিল। তা না হলে এখানে এ রকম একটা গর্ত থাকার কোনও মানে হয় না। অর্থাৎ–‘
অর্থাৎ যে কী আমিও বুঝে নিয়েছিলাম। তবুও মুখে কিছু না বলে আমি ফেলুদাকে কথাটা শেষ করতে দিলাম।
‘অর্থাৎ মিস্টার শিবকুমার শেলভাঙ্কারের অ্যাক্সিডেন্টটা প্রকৃতির নয়, মানুষের কীর্তি। অর্থাৎ অত্যন্ত ক্রুর ও শয়তানি পদ্ধতিতে কেহ বা কাহারা তাহাকে হত্যা করিয়াছিল। অর্থাৎ-এক কথায়-গণ্ডগোল, বিস্তর গণ্ডগোল…’
০৫. খুনের জায়গা
খুনের জায়গা (এখন থেকে আর অ্যাক্সিডেন্ট বলব না) থেকে হোটেলে ফিরে আমাকে নামিয়ে দিয়ে ফেলুদা বলল ওর একটু কাজ আছে–একটু পরে ফিরবে। আমি জানি যে যদি জিজ্ঞেস করি কী কাজ তা হলে উত্তর পাব না।
আমরা ফেরার পথে চৌমাথায় হেলমুটের সঙ্গে দেখা হয়েছিল; তাকে রুমটেকের নাচের কথা বলতে সেও যেতে চাইল। আর যাবেন নিশিকান্তবাবু। কোথায় গেলেন ভদ্রলোক? আর তার সেই হিজিবিজি তিব্বতি লেখার মানে করারই বা কী হ’ল?
একবার মনে হল ফেলুদা না আসা পর্যন্ত বাজারের রাস্তায় পায়চারি করে কাটিয়ে দিই। তারপর মনে হল–নাঃ, হোটেলেই যাই। সঙ্গে একটা গল্পের বই এনেছি, ঘরে বসে সেটা পড়তে পড়তেই ফেলুদা এসে যাবে।
হোটেলে চুকতেই দেখলাম নিশিকাস্তুবাবু গোমড়া মুখ করে ডাইনিং রুমে বসে আছেন। অবিশ্যি আমাকে দেখেই তাঁর সে পুরনো হাসি ফিরে এল। বললেন, ‘দাদা কই?’ বললাম, ‘একটু কাজে বেরিয়েছেন; আসবেন এক্ষুনি৷’
‘তোমার দাদার গায়ে খুব জোর, তাই না?’
এ আবার কী রকম প্রশ্ন করেন। ভদ্রলোক? আমি কিছু বলার আগেই আবার বললেন, ‘উনি ভরসা দিচ্ছেন বলেই রয়ে গেলুম; তা না হলে আজই পাততাড়ি গুটিয়ে দাৰ্জিলিং পালাতুম?’
‘কেন?’
ভদ্রলোক হাত কচলাতে শুরু করেছেন। বুঝলাম তাঁর নার্ভাসনেসটা আবার ফিরে এসেছে।
ভদ্রলোক এ দিক ও দিক দেখে আবার পকেট থেকে সেই কাগজটা বার করলেন। ‘জানি ভাই–সাতজন্মে কারুর কোনও অনিষ্ট করিনি, অথচ এ রকম শাসনি শেষটায় আমাকেই দিলে!’
‘ওটার মানে বের করেছেন নাকি?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘একটা অ্যাং-মানে অ্যাংজাইটি ছিল, তাই সোজা চলে গেলুম তিব্বত ইনস্টিটিউটে। কাগজটা দেখালুম। কী বললে জান? বললে এ লেখাটার মানে হচ্ছে ‘মৃত্যু। গিয়াংফুং–না। ওই জাতীয় একটা কী তিব্বতি কথা। মানে হচ্ছে ডেথ। থার্টি সেভেনে আমার একটা ফাঁড়া আছে তাও জানি।’
আমার একটু বিরক্ত লাগল। বললাম, ‘শুধু তো বলেছে মৃত্যু৷ এমন তো বলেনি যে আপনাকেই মরতে হবে।’
ভদ্রলোক হঠাৎ যেন একটু আশার আলো দেখতে পেলেন।
‘তাও বটে। মৃত্যু মানে তো এনিবডিজ ডেথ হতে পারে।–তাই না?’
‘কাগজে লেখা আছে বলেই যে কাউকে মরতেই হবে তারই বা কী মানে আছে?’
কিন্তু তাও যেন ভদ্রলোক ভরসা পেলেন না! আবার তাঁর মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। তারপর ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভেবে প্রায় নিজের মনেই বিড়বিড় করে বললেন, ‘দক্ষিণের জানালাটা খোলা ছিল.ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিল, তার মানে হাওয়া ছিল…বাইরের জিনিস হাওয়ার সঙ্গে ঘরের ভিতর এসে পড়তে পারে। এটা যদি এমনি উট্কো কাগজের টুকরো হয়…হয়তো ছেড়া পুঁথিটুথির পাতা–কাছাকাছি তো ছোটখাটো গুম্ফাও রয়েছে…একটা তো শহরে ঢোকার মুখটাতেই…হুঁ…হুঁ…’
আমি আর কাল রাত্রে জানালা দিয়ে কী দেখেছি সেটা বললাম না। তা হলে যেটুকু ভরসা পাচ্ছেন ভদ্রলোক, তাও আর পেতেন না। শেষে যেন আর ভাবতে না পেরেই ভদ্রলোক জোর করে তাঁর মন থেকে দুশ্চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘যাকগে! তোমার দাদাই তো রয়েছেন। বেশ কনফিডেন্স পাওয়া যায়। ভদ্রলোককে দেখে। খেলোয়াড়-টেলোয়াড় ছিলেন নাকি? না, এক্সারসাইজ করেন?’
‘এককালে ক্রিকেট খেলেছেন। এখন যোগব্যায়াম করেন৷’
‘ঠিক ধরেচি। আজকালকার বাঙালিদের মধ্যে আমন ফিট বডি চোখে পড়ে না। চা খাবে?’
পাহাড়ে ওঠানামা করতে বেশ পরিশ্রম হয়েছিল, তাই বললাম চায়ে আপত্তি নেই।
ভদ্রলোক বেয়ারাকে ডেকে দু কাপ চা অর্ডার দিলেন। চা এসে পৌঁছতে না পৌঁছতেই ফেলুদা ফিরে এল। আসার দশ সেকেন্ডের মধ্যেই নিশিকান্তবাবু তাঁর ‘মৃত্যু’-র কথাটা ফেলুদাকে বলে দিলেন।
ফেলুদা আরেকবার কাগজটা দেখে বলল, ‘আপনাকে এতটা ইস্পার্ট্যান্স দিচ্ছে কেন সেটা আঁচ করতে পারছেন?’
নিশিকান্তবাবু মাথা নাড়লেন, ‘আমি স্যার আকাশ-পাতাল ভেবেও এর কুল-কিনারা করতে পারছি না।’
ফেলুদা বলল, ‘আর ভাববেন না। কারণ না থাকলে কেউ কারুর মৃত্যু কামনা করে না। আমার বিশ্বাস ওটা যে-ই ফেলে থাকুক না কেন, ঝড়ের রাতে অন্ধকারে ভুল করে ভুল ঘরে ফেলেছে। তিব্বতি তিব্বতিকেই তিব্বতি ভাষায় শাসায়। আপনাকে শাসতে হলে যে ভাষা আপনি জানেন তাতেই শাসানো স্বাভাবিক। নইলে তো শাসনি মাঠে মারা—তাই নয় কি?’