‘মন্দ কী?’ ফেলুদা বলল। ‘কেন বলুন তো?
ভদ্রলোক এ দিক ও দিক দেখে নিয়ে তার কোটের বুক পকেট থেকে একটা হলদেটে কাগজ বার করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিলেন।
‘এটা কী ব্যাপার বলুন তো?’
দেখি কাগজটার উপর কালো কালি দিয়ে কয়েকটা অদ্ভুত অক্ষরে কী যেন লেখা রয়েছে!
ফেলুদা বলল, ‘এ তো তিব্বতি লেখা বলে মনে হচ্ছে। কোথায় পেলেন?
‘কাল রাত্ৰে-মানে মাঝরাত্রেী-অ্যাট, মানে অ্যাট ডেড অফ নাইট–কেউ আমার ঘরে ফেলে দিয়ে গেছে।’
‘বলেন কী!’
আমার কিন্তু কথাটা শুনেই বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। নিশিকান্তবাবুর ঘর হল আমাদের পাশের ঘর; ওটাও হোটেলের পিছন দিকে। আমাদের আর ওর ঘরের জানালার বাইরে দিয়ে একই বারান্দা গেছে, আর সেই বারান্দায় ওঠার জন্য কাঠের সিঁড়ি রয়েছে।
‘এটা রাখতে পারি?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘স্বছ্–মানে স্বচ্ছন্দে। কিন্তু কী লিখেছে, সেটার একটা ইয়ে না করা অবধি…’
‘সেটা আর এমন কী কঠিন। তিব্বতি ভাষা-জানা লোকের তো অভাব নেই এখানে। আর কিছু না হোক–টিবেটান ইনস্টিটিউট তো আছে।’
‘হাঁ। সেই আর কী৷’
‘তবে আর কী। আপনি চিন্তা করছেন কেন? এটা হুমকি বা শাসনি গোছের একটা কিছু, সেটা ভাবার তো কোনও কারণ নেই। নাকি আছে?’
নিশিকান্তবাবু চমকে উঠে। তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়ে বললেন, ‘সার্টেনলি নট!’
‘এমনও তো হতে পারে যে এটায় বলা হয়েছে–তোমার মঙ্গল হোক বা তুমি দীর্ঘজীবী হও।’
‘তা তো বটেই। অবিশ্যি, মানে হঠাৎ, কথা নেই বাতা নেই, আশীর্বাদটাই বা করবে কেন–হেঁ হেঁ।’
‘হুমকিরও কোনও কারণ নেই বলছেন?’
‘না না। আমি মশাই যাকে বলে নট ইন সেভেন, নট ইন ফাইভ।’
ফেলুদা বেয়ারাকে চা আর ডিমা-রুটি অডার দিয়ে বলল, ‘যাক গে—এ নিয়ে আর ভাববেন না। আমরা তো পাশের ঘরেই রয়েছি। আপনার কোনও চিন্তা নেই৷’
‘বলছেন?’ আজ সকালে এই প্রথম ভদ্রলোকের অনেকগুলো দাঁত এক সঙ্গে দেখা গেল।
‘আলবৎ। চা খেয়েছেন?’
‘এবার খাব আর কী৷’
‘পেট ভরে ব্রেকফাস্ট করুন। রোদ উঠেছে। দুপুরে লামা-নাচ দেখার প্রোগ্রাম আছে। কুছ পরোয় নেহি।’
‘আপনাকে যে কী বলে থ্যা—‘
‘থ্যাঙ্কস দিতে হবে না। আপনার চেকটি যেন খোয়া না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।’
জিপি ঠিক সময়ই হাজির হল। আমরা উঠতে যাব, এমন সময় দেখি আরেকটা জিপ বাংলোর দিক থেকে আসছে। নম্বরটা দেখে কেমন জানি চেনা মনে হল। SKM 463, ওহো—এই নম্বরের গাড়িই তো সেই নেপালি ড্রাইভার চালাচ্ছে, যে অ্যাক্সিডেন্ট থেকে পার পেয়েছিল। এবার নীল কোট পরা ড্রাইভারকে দেখতে পেলাম, আর তার পাশেই বসে–ওমা, এ যে শশধরবাবু।
ভদ্রলোক আমাদের দেখে গাড়ি থামিয়ে বললেন, ‘আমির কাছ থেকে খবরের জন্য ওয়েট করছিল। বৃষ্টির বহর দেখে ভয় হচ্ছিল রাস্তা বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘নাঃ। অবিশ্যি নেহাত বেগতিক দেখলে ঠিক করেছিলাম। ভায়া কালিম্পং চলে যাব৷’
‘ওই ড্রাইভারই তো শেলভাঙ্কারের গাড়ি চালাচ্ছিল—তাই না?’
শশধরুবাবু হেসে উঠলেন।’আপনি তো তদন্ত শুরু করে দিয়েছেন দেখছি। ইয়েস-ইউ আর রাইট। আমি ওকে ডেলিবারেটলি বেছে নিয়েছি। প্রথমত, গাড়িটা নতুন; দ্বিতীয়ত-বাজ কখনও একই জায়গায় দুবার পড়ে না, জানেন তো?’
শশধরবাবু দ্বিতীয়বার গুডবাই করে বাজারের রাস্তা দিয়ে নীচের দিকে চলে গেলেন। আমরা আমাদের জিপে উঠলাম। ড্রাইভারকে বলাই ছিল কোথায় যাবে, তাই আর বৃথা বাক্যব্যয় না করে রওনা দিয়ে দিলাম।
ডাকবাংলোর কাছাকাছি গিয়ে একবার উপরের দিকে চেয়ে দেখলাম হেলমুটকে দেখা যায় কি না। কাউকেই দেখতে পেলাম না। কাল কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছিল না, আর আজ আকাশে এক টুকরো মেঘও নেই। বাঁ দিকে শহর অনেক দূর পর্যন্ত নীচে নেমে গেছে। একটা বাড়ি দেখে ইস্কুল বলে মনে হল, কারণ তার সামনেই একটা চারকোেনা খোলা জায়গা, আর তার দুদিকে দুটো খুদে খুদে সাদা গোলপোস্ট। এখনও ইস্কুলের সময় হয়নি, না হলে ইউনিফর্ম পরা খুদে খুদে ছেলেদেরও দেখা যেত।
আরও কিছু দূর গিয়ে একটা চৌমাথা পড়ল। ডান দিকে একটা পান-সিগারেটের দোকান, মাঝখানে পুলিশ, বা দিকে একটা রাস্তা পিছনে নীচের দিকে চলে গেছে। সামনের দিকে রাস্তাটা দু ভাগ হয়ে গেছে। একটার মুখে একটা গোট—তাতে লেখা ইন্ডিয়া হাউস-সেটা পাহাড় বেয়ে উপর দিকে উঠে গেছে। আমরা নিলাম অন্য রাস্তাটা, যেটা সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে।
মিনিট খানেক চলার পরেই রাস্তার ডান পাশে পাহাড়ের গায়ে পাথরের ফলকে খোদাই করে বড় বড় অক্ষরে লেখা দেখলাম–নর্থ সিকিম হাইওয়ে।
ফেলুদা একটা অচেনা গান গুনগুন করে গাইছিল, সেটা থামিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়ে রাস্তা কিতনা দূর তক গিয়া?’
ড্রাইভার বলল রাস্তা গেছে চুংথাম পর্যন্ত। সেখানে আবার দুটো রাস্তা আছে, যার একটা গেছে। লাচেন, আরেকটা লিচুং।। দুটোরই নাম শুনেছি, দুটোরই হাইট না হাজার ফুটের কাছাকাছি, আর দুটোই নাকি অদ্ভুত সুন্দর জায়গা।
‘রাস্ত ভাল?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
‘তা ভাল, তবে পানি হোনেসে কভি কভি বিগড় যাত৷’
‘ল্যান্ডক্সাইড হয়?’
‘হাঁ বাবু। রাস্তা তোড় যাতা, বিরিজ তোড় যাতা, ট্রাফিক সব বন্ধ হো যাত৷’
শহর ছাড়তে বেশি সময় লাগল না। একটা আমি ক্যাম্প পেরোতেই একেবারে নিরিবিলি জায়গায় এসে পড়লাম! এখন নীচের দিকে তাকালে পাকা বাড়ির বদলে ফসলের খেত দেখা যাচ্ছে। এখন ভুট্টা হয়েছে, ধানের সময় ধান হয়৷ পাহাড়ের গা কেটে সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে করা খেত–ভারী সুন্দর দেখতে।