‘প্যাডের কাগজে লেখা হলে তার পরের কাগজে সে লেখার কিছুটা ছাপ থেকে যায়। এ কাগজ একেবারে মসৃণ।’
‘ভেরি গুড। আর কিছু?’
‘আর কিছু এ থেকে বলা অসম্ভব। এ চিঠি ডাক্তে এসেছিল?’
‘হ্যাঁ। পোস্টমার্ক পার্ক স্ট্রিট। তিনদিন আগে এ চিঠি পেয়েছি। আজ শনিবার ২০শে।’
ফেলুদা চিঠিটা ফেরত দিয়ে বলল, ‘এবার আপনাকে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই, কারণ আপনার শিকারের কাহিনী ছাড়া আপনার সম্বন্ধে কিছুই জানা নেই আমার।’
‘বেশ তো। করুন না। মিষ্টি মুখে পুরে খেতে খেতে করুন’।
চাকর রুপোর প্লেটে রসগোল্লা আর অমৃতি রেখে গেছে। ফেলুদাকে খাবার কথা বলতে হয় না। সে টপ করে একটা আস্ত রসগোল্লা মুখে পুরে দিয়ে বলল, ‘চিঠিতে যে জিনিসটার কথা লেখা হয়েছে সেটা কী জানতে পারি?’
কৈলাসবাবু বললেন, ‘ব্যাপারটা কী জানেন—যাতে আমার অধিকার নেই, এমন কোনও জিনিস আমার কাছে আছে বলে আমার জানা নেই। এ বাড়িতে যা কিছু আছে তা সবই হয় আমার নিজের কেনা, না হয় পৈতৃক সম্পত্তি। আর তার মধ্যে এমন কোনও জিনিস নেই যেটা আদায় করার জন্যে কেউ আমাকে এমন চিঠি দিতে পারে। তবে একটিমাত্র জিনিস আছে যেটা বলতে পারেন মূল্যবান ও লোভনীয়।’
‘সেটা কী?’
‘একটা পাথর।’
‘পাথর?’
‘প্রেশাস স্টোন।’
‘আপনার কেনা?’
‘না, কেনা নয়।’
‘পৈতৃক সম্পত্তি?’
‘তাও না। পাথরটা পাই আমি মধ্যপ্রদেশে চাঁদার কাছে একটা জঙ্গলে। একটা বাঘ ধাওয়া করে আমরা তিন-চার জন একটা জঙ্গলে ঢুকেছিলাম। শেষ পর্যন্ত সেটাকে মারা হয়। কাছেই একটা বহু পুরনো ভাঙা পরিত্যক্ত মন্দিরে একটা দেবমূর্তির কপালে পাথরটা লাগানো ছিল। ওটার অস্তিত্ব বোধহয় আমাদের আগে কেউই জানত না।’
‘ওটা কি আপনার চোখেই প্রথম পড়ে?’
‘মন্দিরটা সকলেই দেখেছিল, তবে পাথরটা প্রথম আমিই দেখি।’
‘সঙ্গে আর কে ছিল সেবার?’
‘রাইট বলে এক মার্কিন ছোকরা, কিশোরীলাল বলে এক পাঞ্জাবি, আর আমার ভাই কেদার।’
‘আপনার ভাইও শিকার করেন?’
‘করত। এখন করে কি না জাই না। বছর চারেক হল ও বিদেশে।’
‘বিদেশ মানে?’
‘সুইজারল্যাণ্ড! ঘড়ির ব্যবসার ধান্দায়।’
‘যখন পাথরটা পেলেন তখন ওটা নিয়ে আপনাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি হয়নি?’
‘না। তার কারণ ওটার যে কত দাম সেটা কলকাতায় এসে জহুরিকে দেখাবার পর জানতে পারি।’
‘তারপর সে খবর আর কে জেনেছে?’
‘খুব বেশি লোককে বলিনি। এমনিতে আত্মীয়-স্বজন বিশেষ কেউ নেই। দু-একজন উকিল বন্ধুকে বলেছি, কেদার জানত, আর বোধহয় আমার ভাগনে অবনীশ জানে।’
‘পাথরটা বাড়িতেই আছে?’
‘হ্যাঁ। আমার ঘরেই থাকে।’
‘এত দামি জিনিস ব্যাঙ্কে রাখেন না যে?’
‘একবার রেখেছিলাম। যেদিন রেখেছিলাম তার পরের দিনই একটা মোটর অ্যাক্সিডেন্ট হয়—প্রায় মরতে মরতে বেঁচে যাই। তারপর থেকে ধারণা হয় ওটা কাছে না রাখলে ব্যাড লাক্ আসবে, তাই ব্যাঙ্ক থেকে আনিয়ে নিই।’
‘হুঁ…।’
ফেলুদার খাওয়ার শেষ হয়ে গেছে। ওর ভ্রুকুটি দেখে বুঝলাম ও ভাবতে আরম্ভ করে দিয়েছে। জল খেয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বলল, ‘আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?’
‘আমি, আমার ভাগনে অবনীশ, আর তিনটে পুরনো চাকর। আর আমার বাবাও আছেন, তবে তিনি একেবারে অথর্ব, জরাগ্রস্থ। একটি চাকর তার পিছনেই লেগে থাকে সারাক্ষণ।’
‘অবনীশবাবু কী করেন?’
‘বিশেষ কিছুই না। ওর নেশা ডাকটিকিট সংগ্রহ করা। বলেছে একটা টিকিটের দোকান করবে।’
ফেলুদা একটু ভেবে মনে মনে কী জানি হিসাব করল, ‘আপনি কি চাইছেন আমি এই পত্রলেখকের অনুসন্ধান করি?’
কৈলাসবাবু যেন একটু জোর করেই হেসে বললেন। ‘বুঝতেই তো পারছেন এই বয়সে এ ধরনের অশান্তি কি ভাল লাগে? আর শুধু যে চিঠি লিখছে তা নয়—কাল রাত্রে একটা টেলিফোনও করেছিল। ইংরেজিতে ওই একই কথা বলল। গলা শুনে চিনতে পারলাম না। কী বলল জানেন? বলল, নির্দিষ্ট জায়গায় এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জিনিসটা রেখে না এলে আমার বাড়িতে এসে আমাকে ঘায়েল করে দিয়ে যাবে। অথচ এ পাথর হাতছাড়া করতে আমি মোটেই রাজি নই। তা ছাড়া লোকটার যখন ন্যায্য দাবি নেই, অথচ হুমকি দিচ্ছে—তখন বুঝতে হবে সে বদমাইশ, সুতরাং তার শাস্তি হওয়ার দরকার। সেটা কী করে সম্ভব সেটাই আপনি একটু ভেবে দেখুন।’
‘উপায় তো একটাই। বাইশ তারিখে সন্ধ্যাবেলা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আশেপাশে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তাকে তো আসতেই হবে।’
‘সে নিজে নাও আসতে পারে।’
‘তাতে ক্ষতি নেই। যে-ই এসে লিলি গাছের পাশে ঘুরঘুর করুক না কেন, সে যদি আসল লোক নাও হয়, তাকে ধরতে পারলে আসল লোকের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব হবে না।’
‘কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না। লোকটা ডেনজারাস হতে পারে। সে যখন দেখবে লিলি গাছের তলায় পাথরটা নেই, তখন যে কী করতে পারে তা বলা যায় না। তার চেয়ে বাইশ তারিখের আগে—অর্থাৎ আজ আর কালের মধ্যে এই লোকটি কে তা যদি জানা সম্ভব হত তা হলে খুবই ভাল হত। এই চিঠি, আর ওই একটা টেলিফোন কল এই দুটো থেকে কিছু বার করা যায় না?’
ফেলুদা সোফা ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করে দিয়েছে। ও বলল, ‘দেখুন কৈলাসবাবু, চিঠিতে সে লিখেছে যে, গোয়েন্দার সাহায্য নিলে ফল ভাল হবে না—সুতরাং আমি কিছু করি বা না করি, আপনি যে আমাকে ডেকেছেন, এতেই আপনার বিপদের একটা আশঙ্কা আছে। সুতরাং আপনি বরঞ্চ ভেবে দেখুন যে আমাদের সাহায্য চান কি না।’
কৈলাসবাবু ঠাণ্ডার মধ্যেও রুমাল দিতে তাঁর কপাল মুছে বললেন, ‘আপনি, এবং আপনার সঙ্গে আপনার ভাইটি—এ দুজনকে দেখলে কেউ মনে করবে না যে আপনাদের সঙ্গে গোয়েন্দার কোনও সম্পর্ক আছে। এটা একটা অ্যাডভানটেজ। আপনার নাম লোকে জেনে থাকলেও, আপনার চেহারা জানে কি? মনে তো হয় না। সুতরাং সেদিকে আমার বিশেষ ভয় নেই। আপনি রাজি হলে কাজটা নিন। উপযুক্ত পারিশ্রমিক আমি দেব।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ। তবে যাবার আগে একবার পাথরটা দেখে যেতে চাই!’
‘নিশ্চয়ই।’
কৈলাসবাবুর পাথর ওঁর শোবার ঘরে আলমারির ভিতর থাকে। আমরা ভদ্রলোকের পিছন পিছন একটা শানবাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় পৌঁছলাম। সিঁড়িটা গিয়ে পড়েছে একটা লম্বা, অন্ধকার বারান্দায়। তার দুদিকে সারি সারি প্রায় দশ-বারোটা ঘর, তার অনেকগুলো আবার তালা-বন্ধ। চারিদিকে একটা থমথমে ভাব, আর লোকজন নেই বলেই বোধ হয় সামান্য একটু আওয়াজ হলেই তার প্রতিধ্বনি হয়।
বারান্দার শেষ মাথায় ডানদিকের ঘর হল কৈলাসবাবুর শোবার ঘর। আমরা যখন বারান্দার মাঝামাঝি এসেছি তখন দেখি পাশের একটা ঘরের দরজা অর্ধেক খোলা, আর তার ভিতর দিয়ে একজন ভীষণ বুড়ো লোক গলা বাড়িয়ে ঘোলাটে চোখে আমাদের দিকে দেখছে। আমার তো দেখেই কীরকম ভয় ভয় করতে লাগল। কৈলাসবাবু বললেন, ‘উনিই আমার বাবা। মাথার ঠিক নেই। সব সময়েই এখন দিয়ে ওখান দিয়ে উঁকি মারেন।’
কাছাকাছি যখন এসেছি, তখন বুড়োর চাহনি দেখে সত্যিই আমার রক্ত জল হয়ে গেল। আর সেই ভয়াবহ চাহনি দিয়ে উনি তাকিয়ে রয়েছেন কৈলাসবাবুর দিকে।
বাবার ঘর পেরিয়ে কিছুদির গেলে পর কৈলাসবাবু বললেন, ‘বাবার সকলের উপরেই আক্রোশ। ওঁর ধারণা সকলেই ওঁকে নেকলেক্ট করে। আসলে কিন্তু ওঁর দেখাশোনার ত্রুটি হয় না।’
কৈলাসবাবুর ঘরে দেখলাম প্রকাণ্ড উঁচু খাট, আর তার মাথার দিকে ঘরের কোনায় আলমারি। সেটা খুলে তার দেরাজ থেকে একটা নীল ভেলভেটের বাক্স বার করে বললেন, ‘সাতরামদাসের দোকান থেকে এই বাক্সটা দিনে নিয়েছিলুম এই পাথরটা রাখার জন্য।’
বাক্সটা খুলে নীল আর সবুজ রং মেশানো লিচুর সাইজের একটা ঝলমলে পাথর বার করে কৈলাসবাবু ফেলুদার হাতে দিয়ে বললেন—
‘একে বলে ব্লু বেরিল। ব্রেজিল দেশে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে যে খুব বেশি আছে তা নয়। অন্তত এত বড় সাইজের বেশি নেই সে-বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।’
ফেলুদা পাথরটা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক নাড়িয়ে দেখে ফেরত দিয়ে দিল। এবার কৈলাসবাবু তাঁর পকেট থেকে একটা মানিব্যাগ বার করলেন। তারপর তার থেকে পাঁচটা দশটাকার নোট বার করে ফেলুদার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এইটে আগাম। কাজটা ভালয় ভালয় উতরে গেলে বাকিটা দেব, কেমন?’
‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে ফেলুদা নোটগুলো পকেটে পুরে নিল। চোখের সামনে ওকে রোজগার করতে এই প্রথম দেখলাম।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে ফেলুদা বলল, ‘আমাদের ওই চিঠিখানা আমাকে দিতে হবে, আর অবনীশবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলব।’
নীচে যখন পৌঁছলাম, ঠিক সেই সময় বৈঠকখানা থেকে টেলিফোন বাজতে আরম্ভ করেছে। কৈলাশবাবু তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরলেন।
‘হ্যালো।’
তারপর আর কোনও কথা নেই। আমরা বৈঠকখানায় ঢুকতেই কৈলাসবাবু ফ্যাকাশে মুখ করে ধপ করে টেলিফোনটা রেখে দিয়ে বললেন, ‘আবার সেই লোক, সেই হুমকি।’
‘কী বলল?’
‘এবার আর কোনও সন্দেহ রাখেনি।’
‘তার মানে?’
‘বলল—কোন জিনিসটা চাইছি বুঝতে পারছ বোধহয়। চাঁদার জঙ্গলের মন্দিরে যেটা ছিল সেইটে।’
‘আর কী বলল?’
‘আর কিছু না।’
‘গলা চিনলেন?’
‘না। তবে এইটুকু বলতে পারি যে গলাটা শুনতে ভাল লাগে না। আপনি বরং আরেকবার ভেবে দেখুন।’
ফেলুদা একটু হেসে বলল, ‘আমার ভাবা হয়ে গিয়েছে।’
কৈলাসবাবুর কাছ থেকে অবনীশবাবুর ঘরে গিয়ে দেখি তিনি ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে টেবিলের উপর রাখা কী একটা জিনিস খুব মন দিয়ে পরীক্ষা করছেন। আমরা ঢুকতেই টেবিলের উপর হাতটা চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
‘আসুন, আসুন!’
ফেলুদা বলল্ম ‘আপনার ডাকটিকিটের খুব শখ দেখছি।’
অবনীশবাবুর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, ওই আমার একমাত্র নেশা। বলতে গেলে আমার ধ্যান জ্ঞান চিন্তা।’
‘আপনি কি কোনও দেশ নিয়ে, স্পেশালাইজ করেন, না সারা পৃথিবীর টিকিট জমান?’
‘আগে সারা পৃথিবীরই জমাতুম, কিন্তু কিছুদিন হল ইন্ডিয়াতে স্পেশালাইজ করছি। আমাদের এই বাড়ির দপ্তরে যে কী আশ্চর্য সব পুরনো টিকিট রয়েছে তা বলতে পারি না। অবিশ্যি বেশির ভাগই ইন্ডিয়ার। গত দু মাস ধরে হাজার হাজার পুরনো চিঠির গাদা ঘেঁটে টিকিট সংগ্রহ করেছি।’
‘ভাল কিছু পেয়েছেন?’
‘ভাল? ভাল?’ ভদ্রলোক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ‘আপনাকে বললে বুঝবেন? আপনার এ ব্যাপারে ইন্টারেস্ট আছে?’
ফেলুদা একটু হেসে বলল, ‘একটা বয়সে তো সকলেই ওদিকটায় ঝোঁকে—তাই নয় কী? কেপ-অফ-গুড-হোপের এক পেনি, মরিশাসের দু পেনি আর ব্রিটিশ গায়নার ১৮৫৬ সনের সেই বিখ্যাত স্ট্যামগুলো পাবার স্বপ্ন আমিও দেখেছি। বছর দশেক আগে লাখ খানেক টাকা দাম ছিল ওগুলর। এখন আরও বেড়েছে।’
অবনীশবাবু উত্তেজনায় প্রায় লাফিয়ে উঠলেন।
‘তা হলে মশাই আপনি বুঝবেন। আপনাকে দেখাই। এই দেখুন!’
ভদ্রলোক তার চাপা হাতের তলা থেকে একটা ছোট্ট রঙিন কাগজ ফেলুদাকে দিলেন। দেখি খাম থেকে খোলা রং প্রায় মিলিয়ে যাওয়া একটা টিকিট।
‘কী দেখলেন?’ অবনীশবাবু প্রশ্ন করলেন।
ফেলুদা বলল, ‘শ’খানেক বছরের পুরনো ভারতবর্ষের টিকিট। ভিক্টোরিয়ার ছবি। এ টিকিট আগে দেখেছি।’
‘দেখেছেন তো? এবার এই গ্লাসের মধ্যে দিয়ে দেখুন।’
ফেলুদা ম্যাগনিফাইং গ্লাস চোখে লাগাল।
‘এবার কী দেখছেন?’ ভদ্রলোকের গলায় চাপা উত্তেজনা।
‘এতে তো ছাপার ভুল রয়েছে।’
‘এগজ্যাক্টলি!’
‘POSTAGE কথাটার G-এর জায়গায় C ছাপা হয়েছে।’
অবনীশবাবু টিকিট ফেরত নিয়ে বললেন, ‘তার ফলে এটার দাম কত হচ্ছে জানেন?’
‘কত?’
‘বিশ হাজার টাকা।’
‘বলেন কী?’
‘আমি বিলেত থেকে চিঠি লিখে খোঁজ নিয়েছি। এই ভুলটার উল্লেখ স্ট্যাম্প ক্যাটালতে নেই। আমিই প্রথম এটার অস্তিত্ব আবিষ্কার করলাম।’
ফেলুদা বলল, ‘কনগ্রাচুলেশন্স। কিন্তু আপনার সঙ্গে টিকিট ছাড়াও অন্য ব্যাপারে একটু আলোচনা ছিল।’
‘বলুন।’
‘আপনার মামা—কৈলাসবাবু—তাঁর যে একটা দামি পাথর আছে সেটা আপনি জানেন?’
অবনীশবাবুকে যেন কয়েক সেকেন্ড ভাবতে হল। তারপর বললে, ‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ। শুনেছিলাম বটে। দামি কি না জানি না—তবে ‘লাকি’ পাথর সেটা একবার বলেছিলেন বটে। কিছু মনে করবেন না। আমার মাথায় এখন ডাকটিকিট ছাড়া কিচ্ছু নেই।’
‘আপনি এ বাড়িতে কদ্দিন আছেন?’
‘বাবা মারা যাবার পর থেকেই। প্রায় পাঁচ বছর।’
‘মামার সংগে আপনার গোলমান নেই তো?’
‘কোন মামা? এক মামা তো বিদেশে।’
‘আমি কৈলাসবাবুর কথা বলছি।’
“ও। ইনি অত্যন্ত ভাল লোক, তবে…’
‘তবে কী?’
অবনীশ ভুরু কুঁচকালেন।
‘ক’দিন থেকে—কোনও একটা কারণে—ওঁকে যেন একটু অন্যরকম দেখছি।’
‘কবে থেকে?’
‘এই দু-তিন দিন হল। কাল ওঁকে আমার এই স্ট্যাম্পটার কথা বললাম—উনি যেন শুনেও শুনলেন না। অথচ এমনিতে রীতিমতো ইন্টারেস্ট নেন। আর তা ছাড়া, ওঁর কতগুলো অভ্যেস কীরকম যেন বদলে যাচ্ছে।’
‘উদাহরণ দিতে পারেন?’
‘এই যেমন, এমনিতে রোজ সকালে উঠে বাগানে পায়চারি করেন, গত দুদিন করেননি, ঘুম থেকে উঠেইছেন দেরিতে। বোধহয় রাত জাগছেন বেশি।’
‘সেটার কোনও ইঙ্গিত পেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ। আমি তো একতলায় শুই। আমার ঠিক উপরের ঘরটাই মামার। পায়চারি করার শব্দ পেয়েছে মাঝ রাত্রে। গলার স্বরও পেয়েছি। বেশ জোরে। মনে হল ঝগড়া করছেন।’
‘কার সঙ্গে?’
‘বোধহয় দাদু। দাদু ছাড়া আর কে হবেন। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করারও শব্দ পেয়েছি। একদিন তো সন্দেহ করে সিঁড়ির নীচটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখলাম মামা ছাত থেকে দোতলায় নামলেন, হাতে বন্দুক।’
‘তখন কটা?’
‘রাত দুটো হবে।’
‘ছাতে কী আছে?’
‘কিছুই নেই। কেবল একটা ঘর আছে—চিলেকোঠা যাকে বলে। পুরনো চিঠিপত্র কিছু ছিল ওটায়, সে সব আমি মাস খানেক হল বের করে এনেছি।’
ফেলুদা উঠে পড়ল। বুঝলাম তার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।
অবনীশবাবু বললেন, ‘এ সব কেন জিজ্ঞেস করলেন বলুন তো?’
ফেলুদা একটু হেসে বলল, ‘আপনার মামা কোনও কারণে একটু উদ্বিগ্ন আছেন। তবে সে নিয়ে আপনি ভাববেন না। আপনি স্ট্যাম্প নিয়েই থাকুন। এদিকের ঝামেলা মিটলে একদিন এসে আপনার কালেকশন দেখব’খন।’
কৈলাসবাবুর সঙ্গে একবার শেষ দেখা করে ফেলুদা বলল, ‘আপনাকে ষোলো আনা ভরসা দিতে পারছি না, তবু এটুকু বলেছি যে আপনার ভাবনাটা আমায় ভাবতে দিন। রাত্রে ঘুমোতে চেষ্টা করুন, দরকার হলে ওষুধ খেয়ে। আর ছাতে যাবেন না দয়া করে। এপাড়ার বাড়িগুল যেরকম ঘেঁষাঘেষি আপনার শত্রু পাশের কোনও বাড়িতে এসে আস্তানা গেড়ে থাকলে বিপদ হতে পারে।’
কৈলাশবাবু বললেন, ‘ছাতে গিয়েছিলাম বটে, তবে সঙ্গে বন্দুক ছিল। একটা আওয়াজ পেয়েই গিয়েছিলাম, যদিও গিয়ে কিছুই দেখতে পাইনি।’
‘বন্দুকটা সব সময়ই কাছে রাখেন তো?’
‘তা রাখি। তবে মানুষের মনের উদ্বেগ অনেক সময় তার হাতের আঙুলে সঞ্চারিত হয় সেটা জানেন তো? বেশিদিন এইভাবে চললে আমার টিপের কী হবে জানি না।’
কৈলাস চৌধুরীর পাথর – ০২
পরের দিন ছিল রোববার। সারা দিনের মধ্যে বেশির ভাগটা সময় ফেলুদা ওর ঘরে পায়চারি করেছে। বিকেলে চারটে নাগাত ওকে পায়জামা ছেড়ে প্যান্ট পরতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি বেরোচ্ছ?’
ফেলুদা বলল, ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের লিলি গাছগুলো একবার দেখে আসব ভাবছি। যাবি তো চ।’
ট্রামে করে গিয়ে লোয়ার সারকুলার রোডের মোড়ে নেমে হাঁটতে হাঁটতে পাঁচটা নাগাত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দক্ষিণ গেটটায় পৌঁছলাম। এদিকটায় লোকজন একটু কম আসে। বিশেষ করে সন্ধের দিকটায় যা লোক আসে সবই সামনের দিকে—মানে, উত্তরে—গড়ের মাঠের দিকে।
গেট দিয়ে ঢুকে বিশ হাতে আন্দাজ করে এগিয়ে গিয়ে দেখি বাঁ দিকে সত্যিই লিলি গাছের কেয়ারি। তার প্রথম সারির প্রথম গাছটার নীচেই পাথরটা রাখার কথা।
লিলি গাছের মতো এত সুন্দর জিনিস দেখেও গা-টা কেমন জানি ছম্ছম্ করে উঠল। ফেলুদা বলল, ‘কাকার একটা বাইনোকুলার ছিল না—যেটা সেবার দার্জিলিং নিয়ে গেছিলেন?’
আমি বললাম, ‘আছে?’
মিনিট পনেরো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ঘুরে আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে গেলাম লাইটহাউসের সামনে। ফেলুদার কি সিনেমা দেখার শখ হল নাকি? কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিনেমায় না ঢুকে ও গেল উলটোদিকের একটা বইয়ের দোকানে। এ বই সে বই ঘেঁটে ফেলুদা দেখি একটা বিরাট মোটা স্ট্যাম্পের ক্যাটালগ নিয়ে তার পাতা উলটোতে আরম্ভ করল। আমি পাশ থেকে ফিসফিস করে বললাম, ‘তুমি কি অবনীশবাবুকে সন্দেহ করছ নাকি?’
ফেলুদা বলল, ‘এত যার স্ট্যাম্পের শখ, তার কিছুটা কাঁচা টাকা হাতে পেলে সুবিধে হয় বইকি।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু আমরা যখন দোতলা থেকে একতলায় এলাম, তখন যে টেলিফোনটা এল, সেটা তো আর অবনীশবাবু করেননি।’
‘না। সেটা করেছিল মসলন্দপুরের আদিত্যনারায়ণ সিংহ।’
বুঝলাম ফেলুদা এখন ঠাট্টার মেজাজে রয়েছে, ওর সংগে আপাতত আর এ-বিষয়ে কথা বলা চলবে না।
বাড়ি যখন ফিরলাম তখন আটটা বেজে গেছে। ফেলুদা কোটটা খুলে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ফিয়ে বলল, ‘আমি যতক্ষণ হাতমুখ ধুচ্ছি, তুই ডিরেক্টরি থেকে কৈলাসবাবুর টেলিফোন নাম্বারটা বার কর তো।’
ডিরেক্টরি হাতে নিয়ে টেলিফোনের সামনে বসা মাত্র ক্রিং করে ফোনটা বেজে উঠে আমায় বেশ চমকে দিল। আমাকেই ধরতে হয়। তুলে নিলাম রিসিভারটা।
‘হ্যালো।’
‘কে কথা বলছেন?’
এ কী অদ্ভুত গলা! এ গলা তো চিনি না! বললাম, ‘কাকে চাই?’
কর্কশ গম্ভীর গলায় উত্তর এল, ‘ছেলেমানুষ বয়সে গোয়েন্দাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করা হয় কেন? প্রাণের ভয় নেই?’
আমি ফেলুদাকে নাম ধরে ডাকতে গেলাম, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। কাঁপতে কাঁপতে টেলিফোনটা রেখে দেওয়ার আগে শুনতে পেলাম লোকটা বলল, ‘সাবধান করে দিচ্ছি—তোমাকেও, তোমার দাদাকেও। ফল ভাল হবে না।’
আমি কাঠ হয়ে চেয়ারে বসে রইলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে ফেলুদা বলল, ‘ও কী—ওরকম থুম মেরে বসে আছিস কেন? কার ফোন এসেছিল?’
কোনওমতে ঘটনাটা ফেলুদাকে বললাম। দেখলাম ও-ও গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর পিঠে একটা চাপড় মেনে বলল, ‘ঘাবড়াস না। লোক থাকবে—পুলিশের লোক। বিপদের কোনও ভয় নেই। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে একবার যেতেই হবে কালকে।’
রাত্রে ভাল ঘুম হল না। শুধু যে টেলিফোনের জন্য তা নয়; কৈলাসবাবুর বাড়ির ভিতরের অনেক কিছুই বার বার চোখের স্মাওনে ভেসে উঠছিল। সেই লোহার রেলিং দেওয়া ছাদ পর্যন্ত উঠে যাওয়া সিঁড়ি, দোতলার মার্বেল-বাঁধানো অন্ধকার লম্বা বারান্দা, আর তার দরজার ফাঁক দিয়ে বার করা কৈলাসবাবুর বাবার মুখ। কৈলাসবাবুর দিকে ওরকম ভাবে চেয়েছিলেন কেন তিনি? আর কৈলাসবাবু বন্দুক হাতে ছাতে গিয়েছিলেন কেন? কীসের শব্দ পেয়েছিলেন উনি?
ঘুমোতে যাবার আগে ফেলুদা একটা কথা বলেছিল—‘জানিস, তোপসে—যারা চিঠি লিখে আর টেলিফোন করে হুমকি দেয়—তারা বেশির ভাগ সময় আসলে কাওয়ার্ড হয়।’ এই কথাটার জন্যই বোধ হয় শেষ পর্যন্ত ঘুমটা এসে গেল।