আমার বন্ধুর দ্রুত নিশ্বাসের আর আমার হাতের উপর তার হাতের চাপ থেকেই বুঝতে পারছি। প্রোফেসরের এই কুকীর্তিতে তার মনে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। অপকর্মের জন্য যে ইনিই দায়ী, সেটা। যে এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এই সেদিনই ইনি আমাদের কাছে ওই কবচের গুণগান করেছেন, আর আজ ইনিই সেই আশ্চর্য বস্তুটির সর্বনাশ করে চলেছেন! রাতদুপুরে এই কুকীর্তি যে কী অমানুষিক ভণ্ডামির পরিচয় বহন করে এবং তাঁর উত্তরাধিকারীর প্রতি কী পরিমাণ আক্রোশ যে এতে প্রকাশ পাচ্ছে, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কাজটা ভাবতেও যেমন, দেখতেও ঠিক তেমনই পীড়াদায়ক। আমি নিজে এ ব্যাপারে মোটেই বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু তাও এই আশ্চর্য কবচের এহেন দুর্গতি আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল। আমার সঙ্গীটি আমার হাতে একটা টান দিয়ে নিঃশব্দে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। নিজের ঘরে ফিরে আসার পর মর্টিমার মুখ খুলল।
লোকটা কতবড় শয়তান! এ জিনিস কি স্বপ্নেও ভাবা যায়?
ব্যাপারটা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
হয় শয়তান, না হয় পাগল। এই দুটোর একটা হতেই হবে। আসল ব্যাপারটা শিগগিরই জানা যাবে। এসো আমার সঙ্গে; এখনই একটা এপার ওপার করা দরকার।
একটা প্যাসেজের শেষ প্রান্তে একটা দরজা দিয়ে সোজা মিউজিয়মে ঢোকা যায়। এটা একমাত্র তত্ত্বাবধায়কের ব্যবহারের জন্যই তৈরি। মর্টিমারের দেখাদেখি আমিও আগে পায়ের জুতো-জোড়া খুলে ফেললাম। তারপর নিঃশব্দে চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে মিউজিয়মে ঢুকে ঘরের পর ঘর পেরিয়ে অবশেষে আসল ঘরে পৌঁছলাম। ভদ্রলোক এখনও তাঁর দুষ্কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা নিঃশব্দে তাঁর দিকে অগ্রসর হলাম। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছনোর আগেই তিনি আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে ঘুরে একটা চাপা চিৎকার দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সিম্পসন! সিম্পসন। মর্টিমার তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনেকগুলি দরজা পেরিয়ে শেষ দরজার মুখে বৃদ্ধ প্রহরী মশাইকে আবির্ভূত হতে দেখা গেল। প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াসও একই সঙ্গে তাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। পরমুহূর্তেই তাঁর পিঠে দু দিক থেকে আমাদের দুজনের হাত পড়ল।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ভদ্রলোক! আমি যাচ্ছি আপনাদের সঙ্গে। আপনার ঘরেই চলুন মিঃ মর্টিমার। জবাবদিহির ব্যাপারটা ওখানেই সারা যাবে।
মর্টিমার ক্রোধে এত অধীর যে, তার মুখ দিয়ে কথাই বেরোল না। প্রোফেসরকে মাঝখানে রেখে আমরা তিনজন প্রথমে হলঘরে ফিরে এলাম, সিম্পসন আমাদের পিছনে। শো-কেসের উপর ঝুঁকে পড়ে মর্টিমার কাচটা পরীক্ষা করে দেখল। নীচের সারির প্রথম পাথরটা এর মধ্যেই খানিকটা আলগা হয়ে এসেছে। কবচটা হাতে নিয়ে মর্টিমার প্রোফেসরের দিকে ফিরল–তার দৃষ্টি যেন অগ্নিবর্ষণ করছে।
কী করে পারলেন আপনি, কী করে পারলেন।
কাজটা অত্যন্ত ঘৃণ্য আমি জানি, বললেন প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস। আপনার মনের ভাব আমি বুঝতে পারছি। আমি অনুরোধ করছি, আপনার ঘরে নিয়ে চলুন আমাকে।
কিন্তু এটাকে তো এভাবে ফেলে রাখা যায় না, বলল মর্টিমার। তারপর গভীর দরদের সঙ্গে সে কবচটাকে হাতে তুলে নিল। আমরা রওনা দিলাম। প্রোফেসরের পাশে আমি হাঁটছি, যেন পুলিশ চলেছে হাতেনাতে ধরা-পড়া চোরের পাশে। আমরা সোজা মর্টিমারের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। হতভম্ব সিম্পসন বাইরে রয়ে গেল তার নিজের বুদ্ধি দিয়ে ঘটনাটা অনুধাবন করবার জন্য; প্রোফেসর একটা সোফায় বসলেন। তাঁর শোচনীয় অবস্থা দেখে রাগের পরিবর্তে আমরা দুজনেই তাঁর সম্বন্ধে সংশয়ান্বিত বোধ করছিলাম। ব্র্যান্ডি খাবার পর তিনি খানিকটা প্রকৃতিস্থ হলেন।
এখন অনেকটা সুস্থ বোধ করছি, বললেন ভদ্রলোক। গত কদিনের ধকল আমাকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে। আমি আর পেরে উঠছিলাম না। আমার পক্ষে এ এক চরম বিভীষিকা। একদিন যে-মিউজিয়ম আমারই জিম্মায় ছিল, সেই মিউজিয়মের ঘরেই আমাকে ধরা দিতে হল চোরের মতো! অথচ আপনাকেই বা দোষ দেব কী করে? আপনি আপনার কর্তব্য পালন করেছেন। আমি শুধু এটাই চেয়েছিলাম যে, কেউ টের পাবার আগে আমি যেন আমার কাজটা শেষ করতে পারি। সেটা আজ রাত্রেই হয়ে যেত, কিন্তু…।
আপনি ভিতরে ঢুকলেন কী করে? প্রশ্ন করল মর্টিমার।
আপনি যে দরজা ব্যবহার করেন, সেই দরজা দিয়ে, বললেন প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস। কাজটা অত্যন্ত গর্হিত, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ সৎ। সেখানে কোনও দোষ ধরতে পারবে না কেউ। আসল ঘটনাটা জানলে আপনিও আমাকে আর গাল দেবেন না। আপনার বাসস্থানের দরজার একটা চাবি আর মিউজিয়মে ঢোকার একটা চাবি আমার কাছে ছিল। চাকরি ছাড়ার সময় সেগুলি ফেরত দিইনি। মিউজিয়ম থেকে দর্শকের দল বাইরে বেরোনো মাত্র আমি হলঘরে ঢুকে মমি-কেসটার ভিতর লুকিয়ে পড়তাম। তার পর নিরাপদ বুঝে বেরিয়ে এসে যা করার তা করতাম। যতবার সিম্পসনের পায়ের শব্দ পেতাম, তত বারই আমাকে মমি-কেসের ভিতর আশ্রয় নিতে হত। তারপর কাজ শেষ হলে, যেভাবে ঢুকেছি সেই পথেই বেরিয়ে আসতাম।
তার মানে আপনি একটা মস্ত ঝুঁকি নিয়েছিলেন?
নিতেই হয়েছিল।
কিন্তু কেন? কোন উদ্দেশ্যে আপনাকে এরকম একটা জঘন্য কাজ করতে হল? পাশেই। টেবিলের উপর রাখা কবচটার দিকে হাত দেখিয়ে বলল মর্টিমার।