- বইয়ের নামঃ মাস্টার অংশুমান
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. সেই সকালটার কথা
সেই সকালটার কথা আমি কোনওদিন ভুলতে পারব না। সেদিন ছিল রবিবার। তিনদিন ধরে সমানে বাদলা করে সেদিনই প্রথম ঝলমলে রোদ বেরিয়েছে। আমি একটা অঙ্ক কষে আমার খাতাটা বন্ধ করেছি এমন সময় বিশুদা এল। বিশুদা, বিশ্বনাথ গাঙ্গুলি, আমার জ্যাঠতুতো দাদা। সে একটা সিনেমা কোম্পানিতে কাজ করে। বিশুদা এসেই বলল, হ্যাঁ রে, তোর পুজোর ছুটি কবে থেকে শুরু হচ্ছে? আমি বললাম, সাতই অক্টোবর। কেন?
কারণ তোকে নিয়ে সকাবার তাল করছি।
তার মানে?
দাঁড়া, আগে কাকার সঙ্গে কথা বলি।
বাবা পাশের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন, বিশুদা সটান তাঁর সামনে গিয়ে হাজির হল, আমি তার পিছনে। বাবা কাগজ থেকে মুখ তুলে বললেন, কী রে বিশুসকাল-সকালকী ব্যাপার?
বিশুদার উত্তর শুনেই আমার বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করতে শুরু করল। একটা জরুরি ব্যাপারে তোমার কাছে এসেছি ছোট্কা, বলল বিশুদা, আমাদের ডিরেক্টর সুশীল মিত্তির একটা ছবি করছেন। বেশিরভাগ শুটিং হবে বাইরে–আজমীরে। এতে একটা বছর বারোর ছেলের পার্ট আছে–খুব ভাল পার্ট, প্রায় বিশদিনের কাজ। আমার বিশ্বাস অংশুকে খুব ভাল মানাবে পার্টটাতে। এখন তুমি যদি…
শুধু আমি কেন, বললেন বাবা, আমার ছেলের একটা মতামত নেই?
বাবা যে কথাটা ঠাট্টা করে বলেছেন সেটা জানি, কিন্তু এটা বুঝলাম যে তাঁর খুব একটা আপত্তি নেই। অ্যাটিং জিনিসটা বাবা খুব পছন্দ করেন সেটা আমি জানি। আমাকে গলা ছেড়ে আবৃত্তি করতে বাবাই শিখিয়েছেন, আর ইস্কুলে আবৃত্তি করে প্রাইজ পেলে বাবাই সবচেয়ে বেশি খুশি হন।
ইস্কুল কামাই হবে নাকি? জিজ্ঞেস করলেন বাবা।
হলেও বড়জোর দুচারদিন, বলল বিশুদা। পুজোর ছুটির মধ্যে চোদ্দ আনা কাজ হয়ে যাবে; তারপর হয়তো চার পাঁচদিনের কাজ থাকবে কলকাতার স্টুডিওতে। অংশু তো ভাল ছেলে—দুচারদিন কামাইতে ওর কিছু ক্ষতি হবে না।
অংশুর কথা যে বলছিস, ও পারবে তো?
আলবত, বলল বিশুদা। তবে শুধু আমি বললে তো হবে না। কাল সকালে সুশীলবাবুকে একবার নিয়ে আসছি–সুশীল মিত্তির–আমাদের ডিরেক্টর। তবে ওঁর টেস্ট আমি জানি। আই অ্যাম সিওর অংশুকে ওঁর পছন্দ হবে। আর পার্টটাও খুব ভাল। ওই ছেলেকে নিয়েই যত কাণ্ডকারখানা। ওর পার্টটা ও আগেই পেয়ে যাবে, তুমি পড়িয়ে দিও। ওর কোনও অসুবিধা হবে না। তাছাড়া কাজের সঙ্গে সঙ্গে নতুন দেশ দেখা হবে সেটাও কি কম নাকি? কী রে অংশু, আমার সঙ্গে যেতে আপত্তি নেই তো? বাবা-মা থাকবেন না কিন্তু।
আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম আমার কোনও আপত্তি নেই। আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে।
বিশুদার দৌলতে আমার স্টুডিওতে গিয়ে শুটিং দেখা হয়ে গেছে। মোটামুটি কী ঘটনা ঘটে সেটা আমি জানি। দেখতে দেখতে আমার অনেকবার মনে হয়েছে–ওরকম আমিও পারি, ক্যামেরার সামনে আমার মোটেই ভয় করবে না। আমার ভুলের জন্য একই শট বার বার নিতে হবে না, কক্ষনও না।
অবিশ্যি সেটা কতদুর সত্যি তা এখনও জানি না।
বিশুদা আবার বলল, তোর কোনও চিন্তা নেই। কাজটা করতে তোর কোনও অসুবিধা হবে না। আর ছবি শেষ হয়ে সিনেমায় দেখানো হলে তোর কী নাম হয় দেখিস। এমনকী শ্রেষ্ঠ শিশু অভিনেতা হিসেবে পুরস্কারটা হয়তো পেয়ে যেতে পারে মাস্টার অংশুমান গাঙ্গুলি।
পরের দিন ডিরেক্টর সুশীলবাবু এলেন আমাকে দেখতে। ভদ্রলোক গম্ভীর হলেও, কড়া মেজাজের লোক বলে মনে হল না। উনি বলাতে আমি পুরাতন ভৃত্যটা আবৃত্তি করে শুনিয়ে দিলাম। তাতে মনে হল ভদ্রলোক খুশিই হলেন।
তবে তোমার একটা ক্যামেরা টেস্ট নিতে হবে দু-চারদিনের মধ্যে, বললেন সুশীলবাবু, সে ব্যাপারে বিশু তোমায় জানিয়ে দেবে। কয়েক লাইন কথা তোমার পাঠিয়ে দেব, সেটা তুমি মুখস্থ করে রেখো।
সুশীলবাবু চলে যাবার পর বাবা বলেন, দেখো বাবা, এও একরকম পরীক্ষা কিন্তু। স্কুলের পরীক্ষায় ভাল করো তুমি তেমনই এতেও ভাল করতে হবে। স্কুলে যেমন মাস্টারমশাই তেমনই এখানে ডিরেক্টর হবেন তোমার মাস্টার। তাঁর কথা শুনবে। পড়া যেমন মুখস্থ করো, তেমনই এখানেও তোমার পার্ট ভাল করে মুখস্থ করবে।
আমার ভয় ছিল যে মা হয়তো বেঁকে বসবেন, কিন্তু তিনিও এককথায় রাজি। ছেলে প্রায় এক মাসের জন্য দুরে চলে যাবে শুনে প্রথমে একটু খুঁতখুঁত করলেন, কিন্তু বিশুদাকে মা বাবা দুজনেই এত ভালবাসেন যে তাঁর উপর আমার ভার দিয়ে দুজনেই নিশ্চিন্ত।
আমি যে পার্টটা পেয়েই গেছি, ক্যামেরা টেস্টটা যে শুধু নামকাওয়াস্তে, সেটা বুঝলাম যখন দুদিন পরে বিশুদা আবার এল দরজি নিয়ে আমার জামার মাপ নিতে। কুর্তা আর চাপা পায়জামা পরতে হবে। আমাকে, রাজস্থানি পোশাক। কিন্তু শুধু একরকম পোশাকেই হবে না। আমাকে নাকি দুটো পার্ট করতে হবে: এক হল রাজা ভরত সিং-এর ছেলে অমৃৎ সিং, আর আরেক হল গরিব ইস্কুল মাস্টার গোপীনাথের ছেলে মোহন। দুজনেরই এক বয়স, এক চেহারা। পুরের মেলাতে দুজনের আলাপ হবে। একসঙ্গে দুজন একরকম দেখতে ছেলেকে দেখাবার জন্য ক্যামেরার কারসাজি ব্যবহার করা হবে। দুই নতুন বন্ধুতে মেলা ছেড়ে যাবে একটা নিরিবিলি জায়গায় খেলা করতে। সেখানে দুজন পোশাক অদলবদল করবে মজা করার জন্য। আর তার ফলে তিনজন গুণ্ডা রাজপুত্র ভেবে মোহনকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে। তাদের মতলব হল রাজার কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করে তারপর ছেলেকে ফেরত দেওয়া। এদিকে অমৃৎ বাড়ি ফিরে আসে মোহনের পোশাক পরে, আর এসে বাবা-মাকে সব কথা বলে। ছেলে পার পেয়ে গেছে জেনে বাবা-মা হাঁফ ছাড়েন, কিন্তু অমৃৎ জোর গলায় বলে যে তার বন্ধুকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত সে কারুর সঙ্গে কথা বলবে না। শেষকালে গল্পের হিরো তরুণ পুলিশ ইনস্পেক্টর সূর্যকান্ত রাঠোর অসমসাহসের পরিচয় দিয়ে মোটর সাইকেলে করে দস্যুদের হাত থেকে মোহনকে উদ্ধার করে আনবে।