আমি যা দেখলাম, তাতে আপনা থেকেই আমার মুখ দিয়ে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে পড়ল। এবার মাঝের সারির পাথরগুলোর অবস্থাও হুবহু উপরের সারির মতো। বারোটার মধ্যে আটটা পাথরের উপর দুবৃত্তের হাত পড়েছে। শেষের সারির পাথরগুলো যেমন ছিল তেমনই আছে।
পাথরগুলো কি বদলানো হয়েছে? আমি প্রশ্ন করলাম।
না। মাঝের চারটের মধ্যে এমারেন্ডের রঙে সামান্য একটু বৈষম্য ছিল। এখনও সেটা। রয়েছে। কাজেই ধরে নেওয়া যায় যে, উপরের সারির মতো এগুলোও বদলানো হয়নি। আচ্ছা সিম্পসন, তুমি তো বলছ সন্দেহজনক কোনও শব্দ পাওনি।
না স্যার, প্রহরী জবাব দিল, কিন্তু সকাল হলে পর আমি এই ঘরে এসে কবচটা দেখেই বুঝলাম যে, ওটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ আপনাকে খবর দিই। কিন্তু আমি যতক্ষণ পাহারা দিয়েছি ততক্ষণ কাউকে দেখিনি, কোনও শব্দও পাইনি।
মর্টিমার আমার দিকে ফিরে বলল, এসো আমার সঙ্গে, একটু ব্রেকফাস্ট করা যাক। তার ঘরে পৌঁছতেই সে ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করল, এসব কী ঘটছে বলো তো জ্যাকসন?
সত্যি বলতে কি, এমন অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা আমার অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বাইরে। আমি বললাম, আমার মতে এ কোনও উন্মাদের কীর্তি।
এর মধ্যে কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছ না তুমি?
আমি একটু ভেবে বললাম, এই প্রাচীন কবচটা ইহুদিদের কাছে একটি অতি পবিত্র জিনিস। ধরো, যদি ইহুদি-বিরোধী কোনও দলের কেউ কবচটাকে নষ্ট
না, না, না! চেঁচিয়ে বলে উঠল মর্টিমার। ওটা কোনও কথাই হল না। এমন লোক হয়তো আছে যে কবচটাকে নষ্ট করতে চাইতে পারে, কিন্তু পাথরের চারধারে কুরে কুরে সেগুলোকে আলগা করার চেষ্টা করবে কেন? এর কারণ খুঁজতে হবে অন্য কোথাও। এখন বলো তো, টহলদার সিম্পসন সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা।
ওকে সন্দেহ করার কোনও কারণ আছে কি?
কারণ একমাত্র এই যে, রাত্রে এক সিম্পসন ছাড়া কেউ এ তল্লাটে থাকে না।
কিন্তু এমন অর্থহীন ধ্বংসের কাজ সে করবে কেন? কোনও জিনিস তো চুরি যায়নি।
ধরো যদি তার মাথা খারাপ হয়ে থাকে।
উঁহু। সিম্পসনের মাথায় কোনও গণ্ডগোল নেই, এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।
তুমি নিজে অন্য কাউকে সন্দেহ করো?
তুমিই তো রয়েছ! আমি হালকা হেসে বললাম। ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করার ব্যারাম-ট্যারাম আছে নাকি তোমার?
মোটেই না।
তা হলে এ রহস্য সমাধানের কাজে আমি ইস্তফা দিলাম।
কিন্তু আমি দিচ্ছি না। একটা পন্থা আছে, যার সাহায্যে আমরা এর কিনারা করতে পারব। প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াসের সঙ্গে দেখা করে?
না। স্কটল্যান্ড যাবার দরকার নেই। কী করব সেটা বলছি তোমাকে। ওপরের লাম্বার রুমের একটা স্কাইলাইট দিয়ে মাঝের হলঘরটা দেখা যায়, সেটা তো দেখলে। আমরা হলঘরে বাতি জ্বালিয়ে রেখে ওপরের স্কাইলাইটে চোখ লাগিয়ে বসে থাকব। তুমি আর আমি। দুজনে একজোটে রহস্যের সমাধান করব। যদি এই রহস্যময় ব্যক্তিটি এক-একদিনে চারটে করে পাথরের উপর কাজ করে, তা হলে সে নিশ্চয়ই আজ রাত্রে আবার এসে শেষ সারির চারটে পাথর নিয়ে পড়বে।
উত্তম প্রস্তাব।
আমরা ব্যাপারটা সম্পূর্ণ গোপন রাখব। পুলিশ বা সিম্পসন, কাউকেই কিছু বলব না। রাজি?
অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে রাজি।
.
২.
রাত দশটা নাগাদ আমি মর্টিমারের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। তাকে দেখেই বুঝলাম, সে একটা চাপা উত্তেজনার মধ্যে রয়েছে। হাতে সময় আছে, তাই আমরা দুজনে মর্টিমারের ঘরে বসে ঘণ্টাখানেক ধরে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলাম। অবশেষে একটা সময় এল, যখন রাস্তায় গাড়িঘোড়া পথচারী ইত্যাদির শব্দ কমে গিয়ে পাড়াটা নিস্তব্ধ হয়ে এল। প্রায় বারোটার সময় মর্টিমার আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল অকেজো জিনিসপত্র রাখার ঘরটাতে।
ইতিমধ্যে দিনের বেলায় একবার ঘরটাতে এসে মর্টিমার আমাদের বসার সুবিধার জন্য মেঝেতে চট বিছিয়ে রেখেছে। স্কাইলাইটের শার্সিগুলো স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি হলেও তার উপর ধুলো পড়ে এমন। দশা হয়েছে যে, আমরা নীচের ঘরটা মোটামুটি দেখতে পেলেও, নীচ থেকে কেউ আমাদের দেখতে পাবে না। কাঁচের উপর দুটো ছোট্ট অংশ থেকে ধুলো মুছে ফেলে সেইখানে আমাদের চোখ। লাগানোর ব্যবস্থা করলাম। বিজলি বাতির উজ্জ্বল আলোতে হলঘরের সব কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এমনকী শো-কেসের ভিতরের জিনিসগুলো পর্যন্ত। ঘরে একপাশে দরজার ধারে দাঁড় করানো মিশরীয় মমি-কেস থেকে শুরু করে কাঁচের শো-কেসে রাখা ইহুদির কবচের প্রত্যেকটি ঝলমলে পাথর–সবকিছুই আমরা দেখছি সমান আগ্রহের সঙ্গে। ঘরে মণিমুক্তোর ছড়াছড়ি। কিন্তু কবচের উরিম ও ঘুমিমের বারোটা পাথরের জেল্লা অন্য সব কিছুকে ম্লান করে দিয়েছে। সিকারার সমাধি মন্দিরের ছবি, কাণাকের প্রাচীরচিত্র, মেমফিসের ভাস্কর্য, থিবিসের প্রস্তরলিপি–সবই তন্ময় হয়ে দেখার জিনিস; কিন্তু তা সত্ত্বেও চোখ বারবার চলে যায় কাঁচের নীচে কবচটার দিকে, আর মন উদগ্রীব হয়ে ওঠে ওর রহস্য ভেদ করার জন্য। আমি এই রহস্যের কথাই ভাবছি, এমন সময় আমার বন্ধুটি হঠাৎ নিশ্বাস টেনে আমার কোটের আস্তিনটা সজোরে খামচে ধরল। পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলাম এর কারণ।
হলঘরের দরজার পাশে রাখা মমি-কেসটার কথা আগেই বলেছি। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, দাঁড় করানো মমি-কেসটার ডালাটা খুলতে শুরু করেছে। খোলার ফলে যে সরু কালো ফাঁকটার সৃষ্টি হয়েছে, সেটা অতি ধীরে ধীরে চওড়া হচ্ছে। এই ভোলার ব্যাপারটা এত সন্তর্পণে ঘটছে যে, ভাল করে না দেখলে চোখে ধরাই পড়ে না। একটু পরেই দেখলাম যে, ফাঁক দিয়ে একটা শীর্ণ হাত বেরিয়ে এসে নকশাদার ডালাটাকে ধরে সেটা আরও সামনে এগিয়ে দিল। তারপর বেরিয়ে এল অন্য হাতটা, আর তারপরেই একটা মুখ। এ-মুখ আমাদের দুজনেরই খুব চেনা। ইনি হলেন স্বয়ং প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস। এবার তাঁর পুরো শরীরটা শবাধার থেকে বেরিয়ে এল, শেয়াল যেমন বেরিয়ে আসে তার গর্ত থেকে। ভদ্রলোকের দৃষ্টি ঘুরছে এদিক-ওদিক, পা-দুটো একবার সামনে এগোচ্ছে, পরমুহূর্তেই থামছে, আবার দৃষ্টি ঘুরছে এদিক-ওদিক, আবার এগোচ্ছে পা। একবার রাস্তা থেকে আসা একটা অস্ফুট শব্দে তিনি থেমে গেলেন, কানখাড়া করে শুনতে লাগলেন, ভাবটা এই, যেন দরকার হলে তৎক্ষণাৎ আবার ফিরে যাবেন তাঁর লুকোনোর জায়গায়। কিন্তু সেটার প্রয়োজন। হল না। প্রোফেসর গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে শো-কেসটার সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা চাবির গোছ বার করলেন। তারই একটা চাবি দিয়ে খোলা হল শো-কেসের ঢাকনা, বাইরে বেরিয়ে এল ইহুদির কবচ, আর সেটাকে ঢাকনার উপর রেখে একটা ছোট ধাতব যন্ত্র দিয়ে তার উপর কাজ শুরু করলেন প্রোফেসর। আমাদের একেবারে সরাসরি নীচে দাঁড়ানোর ফলে তাঁর ঝুঁকে-পড়া পিঠটা কবচটাকে ঢেকে দিয়েছে, কিন্তু তাঁর হাত যেভাবে চলছিল তাতে বুঝতেই পারছিলাম, যে-নষ্টামির পরিচয় আমরা পেয়েছি, সেই একই কাজে তিনি মগ্ন!