তুমি কি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাও?
সেখানেও তো গণ্ডগোল। উনি তো সোজাসুজি অস্বীকার করতে পারেন যে, চিঠিটা উনি লেখেননি।
যাই হোক–এ চিঠির উদ্দেশ্য যে সৎ, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই। উনি যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা মানতে কোনও বাধা আছে কি? এখন যে ব্যবস্থা চালু আছে, সেটা কি সতর্কতার দিক দিয়ে যথেষ্ট?
আমার তো তাই বিশ্বাস। দর্শকদের জন্য মিউজিয়ম খোলা থাকে দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত। সেই সময়টা পাশাপাশি দুটো ঘরের জন্য একটি করে গার্ড মোতায়েন থাকে। দুটো ঘরের মাঝখানে যে দরজা–সেখানে দাঁড়ায় গার্ড, ফলে একসঙ্গে দুটো ঘরেই সে চোখ রাখতে পারে।
কিন্তু রাত্রে?
পাঁচটার পর লোহার গেটগুলো সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে গেট খোলার সাধ্যি কোনও চোরের নেই। যে পাহারা দেয়, সে অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক। সে তিন ঘণ্টা অন্তর অন্তর তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সারা মিউজিয়মটা টহল দেয়। প্রত্যেকটি ঘরে একটি করে বিজলিবাতি সারারাত জ্বলে।
তা হলে একমাত্র উপায় হচ্ছে গার্ডগুলিকে রাত্রেও রেখে দেওয়া।
সেটা খরচে পোষাবে না।
অন্তত পুলিশে খবর দিয়ে বললো যে, বেলমোর স্ট্রিটে তারা যেন একটি বিশেষ কনস্টেবলের ব্যবস্থা করে। এই চিঠি যিনি লিখেছেন তিনি যদি তাঁর পরিচয় গোপন করতে চান, তা হলে কিছু বলার নেই। কেন তিনি এটা চাইছেন, সেটা আশা করি এর পর কী ঘটে তার থেকেই বোঝা যাবে।
এর পর অবিশ্যি এ বিষয়ে আলোচনা করার আর কিছু রইল না। আমি বাড়ি ফেরার পর সারারাত মাথা ঘামিয়েও প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াসের চিঠির পিছনে আসল উদ্দেশ্যটা কী, সেটা বুঝতে পারলাম না। এ চিঠি যে তাঁরই লেখা সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মিউজিয়মে যে চোরের উপদ্রব হতে পারে, সেটা তিনি আঁচ করেছিলেন; সেই কারণেই কি তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিলেন? কিন্তু তাই যদি হয়, তা হলে সরাসরি মর্টিমারকে সতর্ক করলেন না কেন? আমি অনেক ভেবেও রহস্যের কিনারা করতে না পেরে শেষরাত্রে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, ফলে আমার উঠতেও দেরি হয়ে গেল।
ঘুমটা ভাঙলও আশ্চর্যভাবে। নটা নাগাদ মর্টিমার হন্তদন্ত হয়ে এসে আমার দরজায় টোকা মেরে ঘরে ঢুকল। তার চাহনিতে গভীর উদ্বেগ। এমনিতে পোশাক-আশাকের ব্যাপারে মর্টিমার খুব পরিপাটি। কিন্তু আজ দেখি তার শার্টের কলার প্রায় খুলে এসেছে, গলার টাই আর মাথার টুপিরও প্রায় সেই দশা। তার সন্ত্রস্ত দৃষ্টি থেকে মোটামুটি বোঝা যায় কী ঘটেছে।
আমি তৎক্ষণাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে বললাম, মিউজিয়মে চোর এসেছিল বুঝি?
ঠিকই ধরেছ। সেই পাথরগুলো–উরিম আর থুমিমের সেই অমূল্য পাথরগুলো! দৌড়ে আসার ফলে মর্টিমার হাঁফাচ্ছে। আমি চললাম থানায়। তুমি যত শিগগির পায়রা চলে এসো জ্যাকসন–গুড বাই!
উদভ্রান্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মর্টিমার, আর পরক্ষণেই শুনলাম তার দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে নামার শব্দ।
আমি ওর কথামতো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিউজিয়মে পৌঁছে দেখি, মর্টিমার এর মধ্যেই একটি ইনস্পেক্টর ও আর একটি ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছে। ভদ্রলোকটি হলেন মিঃ পার্ভিস–বিখ্যাত হীরক ব্যবসায়ী মবসন অ্যাণ্ড কোং-এর একজন অংশীদার। নামকরা জহুরি হিসাবে ইনি পাথর চুরির ব্যাপারে পুলিশকে সাহায্য করতে সদা প্রস্তুত। ইহুদির কবচটা যে শো-কেসের মধ্যে ছিল, সেটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনজন। কবচটা এখন বাইরে বার করে কাঁচের আচ্ছাদনটার উপর রাখা হয়েছে, আর তিনজনে গভীর মনোযোগের সঙ্গে সেটাকে পরীক্ষা করছে।
কবচটার উপর যে মানুষের হাত পড়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, বলল মর্টিমার। আজ সকালে এটার দিকে চোখ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সন্দেহ হয়। কাল রাত্রেও আমি এটা দেখেছি, তখন ঠিকই ছিল। অর্থাৎ কুকীর্তিটা হয়েছে মাঝরাত্রে।
মর্টিমার ঠিকই বলেছে; কবচটা নিয়ে কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। প্রথম সারির চারটে পাথরকে ঘিরে সোনার উপর ক্ষতচিহ্ন। পাথরগুলো তাদের জায়গাতেই রয়েছে; ক্ষতি যা হয়েছে, সেটা সোনার সূক্ষ্ম কারুকার্যে–যার সৌন্দর্যের তারিফ আমরা এই কদিন আগেই করেছি।
ইনস্পেক্টর সাহেব বললেন, দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যেন পাথরগুলোকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল।
মর্টিমার বলল, আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, শুধু চেষ্টাই করেনি, কৃতকার্য হয়েছিল। আমার ধারণা, প্রথম সারির চারটে পাথরই নকল, যদিও চোখে দেখে ধরার উপায় নেই।
জহুরি মশাইয়েরও মনে হয়তো একই সন্দেহের উদয় হয়েছিল, কারণ তিনি এখন আতশ কাঁচের সাহায্যে অতি মনোযোগের সঙ্গে পাথরগুলো যাচাই করছেন। কাঁচের সাহায্য ছাড়াও নানাভাবে সেগুলোকে পরীক্ষা করে অবশেষে মর্টিমারের দিকে চেয়ে একগাল হেসে ভদ্রলোক বললেন, আপনার কপাল ভাল। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে, প্রথম সারির চারটে পাথরই খাঁটি। এত নিখুঁত পাথর সচরাচর দেখা যায় না।
আমার বন্ধুর মুখ থেকে ফ্যাকাশে ভাবটা চলে গেল। সে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, যাক, বাবা! কিন্তু তা হলে চোরের উদ্দেশ্যটা ছিল কী?
হয়তো পাথরগুলো নেওয়ার মতলবেই এসেছিল, কিন্তু সেকাজে বাধা পড়ে।
কিন্তু নেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হবে, তা হলে তো একটা একটা করে খুলে নেওয়া উচিত। এখানে দেখছি চারটে পাথরকেই আলগা করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু একটাকেও নেওয়া হয়নি।