নাসিরুদ্দিন তাদের কাছে প্রস্তাব করলে যে, জনপিছু এক পয়সা করে নিয়ে সে নজনকে পর পর কাঁধে করে পার করে দেবে। অন্ধরা রাজি হয়ে গেল।
নাসিরুদ্দিন আটজনকে পার করে ননম্বরের বেলায় মাঝনদীতে হোঁচট খেতে পিঠের অন্ধ জলে। তলিয়ে গেল।
বাকি আটজন দেরি দেখে ওপার থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কী হল মোল্লাসাহেব?
এক পয়সা বাঁচল তোমাদের, বললে নাসিরুদ্দিন।
.
৯.
নাসিরুদ্দিন আর তার গিন্নি একদিন বাড়ি ফিরে এসে দেখে চোর এসে বাড়ি তছনছ করে দিয়ে গেছে। গিন্নি তো রেগে আগুন। বললে, এ তোমার দোষ। সদর দরজায় তালা দাওনি, তাই এই দশা।
পড়শিরাও সেই একই সুর ধরলে। একজন বললে, জানলাগুলোও তো ভাল করে বন্ধ করোনি দেখছি।
আরেকজন বললে, চোর আসতে পারে সেটা আগেই বোঝা উচিত ছিল।
আরেকজন বললে, দরজার তালাগুলোও পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
কী আপদ! বললে নাসিরুদ্দিন, তোমরা দেখছি শুধু আমার পিছনেই লাগতে শুরু করলে!
দোষ তো তোমারই মোল্লাসাহেব, পড়শিরা বললে।
বটে? বললে নাসিরুদ্দিন, আর চোরের বুঝি দোষ নেই?
.
১০.
নাসিরুদ্দিনের ভারী শখ একটা নতুন জোব্বা বানাবে, তাই পয়সা জমিয়ে দরজির দোকানে গেল ফরমাশ দিতে। দরজি মাপ নিয়ে বললে, আল্লা করেন তো এক সপ্তাহ পরে আপনি জোব্বা পেয়ে যাবেন।
নাসিরুদ্দিন এক সপ্তাহ কোনওরকমে ধৈর্য ধরে তারপর আবার গেল দরজির দোকানে।
একটু অসুবিধা ছিল মোল্লাসাহেব, বললে দরজি, আল্লা করেন তো কাল আপনি অবশ্যই জোব্বা পেয়ে যাবেন।
পরদিন গিয়েও হতাশ। মাফ করবেন মোল্লাসাহেব, বললে দরজি, আর একটি দিন আমাকে সময় দিন। আল্লা করেন তো কাল সকালে নিশ্চয় রেডি পাবেন আপনার জোব্বা।
নাসিরুদ্দিন এবার বললে, আল্লা না করে তুমি করলে জোব্বাটা কবে পাব সেটা জানতে পারি কি?
.
১১.
এক প্রবীণ দার্শনিক সরাইখানায় বসে বিলাপ করছেন, বিচিত্র জীব এই মানুষ। কোনও কিছুতেই তৃপ্তি নেই। শীতকালে বলে ঠাণ্ডায় মলাম, গ্রীষ্মে বলে গরমে প্রাণ আইঢাই।
সবাই তার কথায় সায় দিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
বসন্তের বিরুদ্ধে যার নালিশ আছে সে হাত তোলো, বললে নাসিরুদ্দিন।
.
১২.
নাসিরুদ্দিনের গানবাজনা শেখার শখ হয়েছে। এক জবরদস্ত ওস্তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে, আপনি বাদ্যযন্ত্র শেখাতে কত নেন?
প্রথম মাসে তিন রৌপ্যমুদ্রা, তারপর থেকে প্রতি মাসে এক রৌপ্যমুদ্রা।
বেশ, তা হলে দ্বিতীয় মাস থেকেই শুরু করব আমি, বললে নাসিরুদ্দিন।
.
১৩.
এক চোর নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে ঢুকে তার প্রায় সর্বস্ব চুরি করে রওনা দিল নিজের বাড়ির দিকে।
নাসিরুদ্দিন রাস্তা থেকে সব দেখে একটি কম্বল কাঁধে নিয়ে চোরের পিছু ধাওয়া করে তার বাড়িতে ঢুকে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে।
কে হে তুমি? চোর জিজ্ঞেস করলে, আমার বাড়িতে কেন?
আমার জিনিস যখন সবই এখানে, বললে নাসিরুদ্দিন, এখন থেকে এটাই আমার বাড়ি নয় কি?
.
১৪.
সরাইখানায় কজন সৈনিকের আগমন হয়েছে। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের বীরত্বের বড়াই করছে। একজন বললে, খোলা তলোয়ার হাতে এমন তেজের সঙ্গে ছুটলাম আমি দুশমনের দিকে যে-তারা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আমায় রেখে কার সাধ্য!
সবাই একথা শুনে সমস্বরে বাহবা দিলে। নাসিরুদ্দিনও এককালে যুদ্ধ করেছে। সে বললে, তোমার কথা শুনে আমার নিজের একটা যুদ্ধের ঘটনা মনে পড়ছে। এক শত্রুর পা কেটে ফেলেছিলাম তলোয়ারের এক কোপে।
তাই শুনে এক প্রবীণ যোদ্ধা বললে, ওইখানেই তো ভুল। কাটা উচিত ছিল মুণ্ডুটা।
মুণ্ডুটা না থাকলে আর মুণ্ডু কাটব কোত্থেকে? বললে নাসিরুদ্দিন।
.
১৫.
এক পড়শি মোল্লাসাহেবের কাছে একগাছ দড়ি ধার চাইতে এসেছে।
পাবে না বলে নাসিরুদ্দিন।
কেন মোল্লাসাহেব?
দড়ি কাজে লাগছে।
ওটা তো মাটিতে পড়ে আছে আজ কদিন থেকে মোল্লাসাহেব।
ওটাই কাজ।
পড়শি তবু আশা ছাড়ে না। বললে, কদিন চলবে কাজ মোল্লাসাহেব?
যদ্দিন না ওটা ধার দেওয়া দরকার বলে মনে করি বললে নাসিরুদ্দিন।
.
১৬.
নাসিরুদ্দিন হামামে গেছে গোসল করতে। পরিচারক তার ছেঁড়া পোশাক দেখে আধখানা সাবান আর একটা ময়লা তোয়ালে ছুঁড়ে দিলে তার দিকে।
নাসিরুদ্দিন কিন্তু যাবার সময় তাকে ভালরকম বকশিশ দিয়ে গেল। পরিচারক ভাবলে, এ কেমন হল? খাতির না করেই যদি এত পাওয়া যায় তা হলে খাতির করলে না জানি কত মিলবে!
পরের সপ্তাহে নাসিরুদ্দিন আবার গেছে হামামে। এবার তাকে দেখেই পরিচারক একেবারে বাদশার হালে তার তোষামোদ করেছে। আচ্ছা রকম দলাই-মালাই করে, গায়ে আতর ছিটিয়ে দিয়ে, কাজের শেষে হাত পাততেই নাসিরুদ্দিন তাকে একটি তামার পয়সা দিয়ে বললে, গতবারের জন্য এই বকশিশ। এবারেরটা তো আগেই দেওয়া আছে।
.
১৭.
নাসিরুদ্দিন এক আমীরের বাড়ি গেছে দুর্ভিক্ষের চাঁদা তুলতে। দরোয়ানকে বললে, তোমার মনিবকে গিয়ে বলল মোল্লাসাহেব চাঁদা নিতে এসেছেন।
দরোয়ান ভিতরে গিয়ে মিনিটখানেক পরে ফিরে এসে বললে, আজ্ঞে, মনিব একটু বাইরে গেছেন।
তা হলে তোমায় একটা কথা বলে যাই,বললে নাসিরুদ্দিন, তোমার মনিব এলে তাঁকে বোলো যে, বেরোবার সময় তাঁর মুণ্ডুটা যেন জানলার ধারে রেখে না যান। কখন চোর আসে বলা কি যায়!
সন্দেশ, শারদীয়া ১৩৮৫
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প
১.