আগে কাগজ কলম আনা হোক, জাঁহাপনা, বললে নাসিরুদ্দিন।
কাগজ কলম এল।
এদের সাতজনকে একটি করে দেওয়া হোক।
তাও হল।
এবার সাতজনে আলাদা করে আমার প্রশ্নের জবাব লিখুন। প্রশ্ন হল-রুটির অর্থ কী?
সাত পণ্ডিত উত্তর লিখে রাজার হাতে কাগজ দিয়ে দিলেন, রাজা পর পর উত্তরগুলো পড়ে গেলেন।
পয়লা নম্বর লিখেছেন রুটি একপ্রকার খাদ্য।
দুই নম্বর–ময়দা ও জলের সংমিশ্রণে তৈয়ারি পদার্থকে বলে রুটি।
তিন নম্বর–রুটি ঈশ্বরের দান।
চার নম্বর–একপ্রকার পুষ্টিকর আহার্যকে বলে রুটি।
পাঁচ নম্বর–রুটির অর্থ করতে গেলে আগে জানা দরকার, কোনপ্রকার রুটির কথা বলা হচ্ছে।
ছয় নম্বর–রুটির অর্থ এক মূর্খ ব্যক্তি ছাড়া সকলেই জানে।
সাত নম্বর–রুটির প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার।
উত্তর শুনে নাসিরুদ্দিন বললে, জাঁহাপনা, যে জিনিস এঁরা প্রতিদিন খাচ্ছেন, তার মানে এঁরা সাতজন সাতরকম করলেন, অথচ যে লোককে এঁরা কখনও চোখেই দেখেননি তাকে সকলে একবাক্যে নিন্দে করছেন। এক্ষেত্রে কে বিজ্ঞ কে মূর্খ সেটা আপনিই বিচার করুন।
রাজা নাসিরুদ্দিনকে বেকসুর খালাস দিলেন।
.
৭.
নাসিরুদ্দিনের দজ্জাল গিন্নি ফুটন্ত সুরুয়া এনে কর্তার সামনে রাখল তার জিভ পুড়িয়ে তাকে জব্দ করবে বলে, কিন্তু ভুলে সে নিজেই দিয়ে ফেলেছে তাতে চুমুক। ফলে তার চোখে জল এসে গেছে।
নাসিরুদ্দিন তাই দেখে বলে, হল কী? কাঁদছ নাকি?
গিন্নি বললেন, মা মারা যাবার ঠিক আগে সুরুয়া খেয়েছিলেন, আহা! সেই কথাটা মনে পড়ে গেল।
এবার নাসিরুদ্দিনও সুরুয়ায় চুমুক দিয়েছে, আর তার ফলে তারও চোখ ফেটে জল।
সে কী, তুমিও কাঁদছ নাকি? শুধোলেন গিন্নি।
নাসিরুদ্দিন বললে, তোমায় জ্যান্ত রেখে তোমার মা মারা গেলেন, এটা কি খুব সুখের কথা?
সন্দেশ, পৌষ ১৩৮৪
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের আরো গল্প (২)
১.
রাজদরবারে নাসিরুদ্দিনের খুব খাতির।
একদিন খুব খিদের মুখে বেগুন ভাজা খেয়ে ভারী খুশি হয়ে রাজা নাসিরুদ্দিনকে বললেন, বেগুনের মতো এমন সুস্বাদু খাদ্য আর আছে কি?
বেগুনের জবাব নেই, বললে নাসিরুদ্দিন।
রাজা হুকুম দিলেন, এবার থেকে রোজ বেগুন খাব।
তারপর পাঁচদিন দুবেলা বেগুন খেয়ে ছদিনের দিন রাজা হঠাৎ বেঁকে বসলেন। খানসামাকে ডেকে বললেন, দূর করে দে আমার সামনে থেকে এই বেগুন ভাজা।
বেগুন অখাদ্য, সায় দিয়ে বললে নাসিরুদ্দিন।
রাজা একথা শুনে ভারী অবাক হয়ে বললেন, সে কী মোল্লাসাহেব, তুমি যে এই সেদিনই বললে বেগুনের জবাব নেই!
আমি তো আপনার মোসাহেব, জাঁহাপনা, বললে নাসিরুদ্দিন, বেগুনের তো নই।
.
২.
নাসিরুদ্দিন সরাইখানায় ঢুকে গম্ভীরভাবে মন্তব্য করলে, সুর্যের চেয়ে চাঁদের উপকারিতা অনেক বেশি।
কেন মোল্লাসাহেব? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলে সবাই।
চাঁদ আলো দেয় রাত্তিরে, বললে নাসিরুদ্দিন, দিনে আলোর দরকারটা কী শুনি?
.
৩.
নাসিরুদ্দিন তার এক বন্ধুকে নিয়ে সরাইখানায় ঢুকেছে দুধ খাবে বলে। পয়সার অভাব, তাই এক গেলাস দুধ দুজন আধাআধি করে খাবে।
বন্ধু বললে, তুমি আগে খেয়ে নাও তোমার অর্ধেক। বাকিটা আমি পরে চিনি দিয়ে খাব।
চিনিটা আগেই দাও না ভাই, বললে নাসিরুদ্দিন, তা হলে দুজনেরই দুধ মিষ্টি হবে।
বন্ধু মাথা নাড়লে। আধ গেলাসের মতো চিনি আছে আমার সঙ্গে, আর নেই।
নাসিরুদ্দিন সরাইখানার মালিকের সঙ্গে দেখা করে খানিকটা নুন নিয়ে এল। ঠিক আছে, সে বললে বন্ধুকে, এই নুন ঢাললাম দুধে। আমি অর্ধেক নোনতা খাব, বাকি অর্ধেক মিষ্টি খেও তুমি।
.
৪.
মোল্লা এক ছোঁকরাকে মাটির কলসি দিয়ে পাঠালে কুয়ো থেকে জল তুলে আনতে। দেখিস, কলসিটা ভাঙিসনি যেন, বলে একটা থাপ্পড় মারলে ছোঁকরার গালে।
এক পথচারী ব্যাপারটা দেখে বললে, কলসি না ভাঙতেই চড়টা মারলেন কেন মোল্লাসাহেব?
তোমার যা বুদ্ধি,বললে নাসিরুদ্দিন, ভাঙার পরে চড় মারলে কি আর কলসি জোড়া লেগে যাবে?
.
৫.
নাসিরুদ্দিন একটা মনিহারী দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে, এখানে পেরেক পাওয়া যায়?
আজ্ঞে হ্যাঁ, বললে দোকানদার।
আর চামড়া?
আজ্ঞে হ্যাঁ, যায়।
আর সুতো?
যায়, আজ্ঞে।
আর রঙ?
তাও যায়।
তা হলে তুমি বসে না থেকে একটা জুতো তৈরি করে ফেলো না বাপু!
.
৬.
নাসিরুদ্দিন এক পড়শির কাছে গিয়ে হাত পাতলে। এক গরিব তার দেনা শোধ করতে পারছে না। তার সাহায্যে যদি কিছু দেন।
পড়শির মনটা দরাজ, সে খুশি হয়ে তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললে, আহা বেচারি! এই ঋণগ্রস্ত অভাগাটি কে, মোল্লাসাহেব?
আমি, বলে নাসিরুদ্দিন হাওয়া।
কিছুদিন পরে নাসিরুদ্দিন আবার সেই পড়শির কাছে এসে হাত পেতেছে। পড়শি একবার ঠকে সেয়ানা হয়ে গেছে। বললে, বুঝেছি। দেনাদারটি এবারও তুমিই তো?
আজ্ঞে না। বিশ্বাস করুন। এবার সত্যিই আমি না।
পড়শির আবার মন ভিজল। নাসিরুদ্দিনের হাতে টাকা দিয়ে বললে, এবার কার দুঃখ দূর করতে যাচ্ছ মোল্লাসাহেব?
আজ্ঞে, আমার।
কীরকম?
আজ্ঞে এই অধম এবার পাওনাদার।
.
৭.
সুসংবাদ দিলে বকশিশ পায় জেনে একজন লোক নাসিরুদ্দিনকে গিয়ে বললে, তোমার জন্য খুব ভাল খবর আছে, মোল্লাসাহেব।
কী খবর?
তোমার পাশের বাড়িতে পোলাও রান্না হচ্ছে।
তাতে আমার কী?
তোমাকে সে পোলাওয়ের ভাগ দেবে বলছে।
তাতে তোমার কী?
.
৮.
নাসিরুদ্দিন নদীর ধারে বসে আছে, এমন সময় দেখে নজন অন্ধ নদী পেরোবার তোড়জোড় করছে।