হাজার বছর আগে কারা এখানে বাস করত? তারা কি মঙ্গলগ্রহের প্রাণী, নাকি এদেরই মতো পৃথিবীতে মরে যাওয়া সব মানুষ!
মঙ্গলগ্রহের প্রাণী। কথাটা দুবার মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলেন জন ব্ল্যাক।
হঠাৎ তাঁর চিন্তা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হল। সব কিছুর একটা মানে হঠাৎ তাঁর মনে জেগে উঠেছে। রক্ত হিমকরা মানে। অবিশ্যি সেটা বিশ্বাস করার কোনও যুক্তি নেই, কারণ ব্যাপারটা অসম্ভব। নিছক আজগুবি কল্পনা মাত্র। ভুলে যাও, ভুলে যাও…মন থেকে দূর করে দাও।
কিন্তু তবু তাঁর মন বলল–একবার তলিয়ে দেখা যাক না ব্যাপারটা। ধরা যাক যে, এরা মঙ্গলগ্রহেরই অধিবাসী। ওরা আমাদের রকেটকে নামতে দেখেছে, এবং সঙ্গে সঙ্গে ওদের মনে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে। ধরা যাক, এরা তৎক্ষণাৎ স্থির করেছে এই পৃথিবীবাসীদের ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু ঠিক সোজাসুজি নয়, একটু বাঁকা ভাবে। যেন তাতে একটু চালাকি থাকে, শয়তানি থাকে; যাতে সেটা পৃথিবীর প্রাণীদের কাছে আসে অপ্রত্যাশিতভাবে, আচমকা। এক্ষেত্রে আণবিক মারণাস্ত্রের অধিকারী মানুষের বিরুদ্ধে এরা কী অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারে?
এ প্রশ্নেরও উত্তর আছে। টেলিপ্যাথির অস্ত্র, সম্মোহনের অস্ত্র, কল্পনাশক্তির অস্ত্র।
এমন যদি হয় যে, এই সব গাছপালা বাড়িঘর, এই পিতলের খাট–আসলে এর কোনওটাই বাস্তব নয়, সবই আমার কল্পনাপ্রসূত, যে কল্পনার উপর কর্তৃত্ব করছে টেলিপ্যাথি ও সম্মোহনী শক্তির অধিকারী এই মঙ্গলবাসীরা হয়তো এই বাড়ির চেহারা অন্য রকম, যেমন বাড়ি শুধু মঙ্গল গ্রহেই হয়, কিন্তু এদের টেলিপ্যাথি এবং হিপনোসিসের কৌশলে আমাদের চোখে এর চেহারা হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীরই একটি ছোট পুরনো শহরের বাড়ির মতো। ফলে আমাদের মনে একটা প্রসন্নভাব এসে যাচ্ছে আপনা থেকেই। তার উপর নিজেদের হারানো বাবা-মা ভাইবোনকে পেলে কার না মন আনন্দে ভরে যায়?
এই শহরের বয়স আমি ছাড়া আমাদের দলের সকলের চেয়ে বেশি। আমার যখন ছ বছর বয়স তখন আমি ঠিক এই রকম শহর দেখেছি, এই রকম গানবাজনা শুনেছি, ঘরের ভিতর ঠিক এইরকম আসবাব, এই ঘড়ি, এই কাপেট দেখেছি। এমন যদি হয় যে, এই দুর্ধর্ষ চতুর মঙ্গলবাসীরা আমারই স্মৃতির উপর নির্ভর করে ঠিক আমারই মনের মতো একটি শহরের চেহারা আমাদের সামনে উপস্থিত করেছে। শৈশবের স্মৃতিই সবচেয়ে উজ্জ্বল, এমন কথা শোনা যায়। আমার স্মৃতির শহরকে বাস্তব রূপ দিয়ে তারপর তারা আমার রকেটের অন্য যাত্রীদের স্মৃতি থেকেও তাদের মৃত প্রিয়জনদের এই শহরের বাসিন্দা করে দিয়েছে।
ধরা যাক পাশের ঘরে যে বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা শুয়ে আছেন, তাঁরা আসলে মোটেই আমার মা বাবা নন। আসলে তাঁরা ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন দুই মঙ্গলগ্রহবাসী, যারা আমার মনে তাঁদের ইচ্ছামতো ধারণা আরোপ করতে সক্ষম।
আর রকেটকে ঘিরে আজকের ওই আমোদ ও ব্যান্ড-বাদ্য? কী আশ্চর্য বুদ্ধি কাজ করছে ওর পিছনে যদি সত্যিই এটা টেলিপ্যাথি হয়। প্রথমে লাস্টিগকে হাত করা গেল,তার পর হিংস্টনকে, তার পর রকেটের বাকি সব যাত্রীদের ঘিরে ফেলা হল গত বিশ বছরের মধ্যে হারানো তাদের আত্মীয় ও প্রিয়জনদের দিয়ে, যাতে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমার হুকুম অগ্রাহ্য করে। রকেট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কী হতে পারে? এখানে মনে সন্দেহ প্রবেশ করার সুযোগ কোথায়? তাই তো এখন দলের সকলেই শুয়ে আছে বিভিন্ন বাড়িতে, বিভিন্ন খাটে, নিরস্ত্র অবস্থায়; আর রকেটটাও খালি পড়ে আছে চাঁদনি রাতে। কী ভয়াবহ হবে সেই উপলব্ধি, যদি সত্যিই জানা যায় যে, এই সমস্ত ঘটনার পিছনে রয়েছে আমাদের সকলকে হত্যা করার অভিসন্ধি। হয়তো মাঝরাত্রে আমার পাশের খাটে আমার ভাইয়ের চেহারা বদলে গিয়ে হয়ে যাবে ভয়ঙ্কর একটা কিছু–যেমন চেহারা সব মঙ্গলবাসীরই হয়। আর সেইসঙ্গে অন্য পনেরোটা বাড়িতে আমার দলের লোকদের প্রিয়জনদেরও চেহারা যাবে পালটে, আর তারা শুরু করবে ঘুমন্ত পৃথিবীবাসীদের সংহার…
চাদরের তলায় ক্যাপ্টেন জনের হাত দুটো আর স্থির থাকছে না। আর তাঁর সমস্ত শরীর হয়ে গেছে বরফের মতোঠাণ্ডা। যা এতক্ষণ ছিল কল্পনা, তা এখন বাস্তব রূপ ধরে তাঁর মনে গভীর। আতঙ্কের সঞ্চার করছে।
ধীরে ধীরে ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক বিছানায় উঠে বসলেন। রাত এখন নিস্তব্ধ। বাজনা থেমে গেছে। বাইরে বাতাসের শব্দও আর নেই। পাশের খাটে ভাই শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
অতি সন্তর্পণে গায়ের চাদরটা গুটিয়ে পাশে রাখলেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক। তারপর খাট থেকে নেমে কোনও শব্দ না করে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই ভাইয়ের কণ্ঠস্বরে থমকে দাঁড়ালেন।
কোথায় যাচ্ছ দাদা?
কী বললে?
এত রাত্রে কোথায় যাচ্ছ?
জল খেতে যাচ্ছিলাম।
কিন্তু তোমার তো তেষ্টা পায়নি।
হ্যাঁ, পেয়েছে।
আমি জানি পায়নি।
ক্যাপ্টেন জন পালাবার চেষ্টায় দৌড়ে গেলেন দরজার দিকে। কিন্তু দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন না।
পরদিন সকালে মঙ্গলবাসীদের ব্যান্ডে শোনা গেল করুণ সুর। শহরের অনেক বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল লম্বা লম্বা কাঠের বাক্স বহনকারীর দল। মৃত ব্যক্তিদের বাপ-মা-ভাই-বোন সকলের চোখেই জল, তারা চলেছে গিজার দিকে, যেখানে মাটিতে ষোলোটি নতুন গর্ত খোঁড়া হয়েছে।