আয়, লাঞ্চের সময় হয়েছে। আমি মাকে বলে রেখেছি।
লাস্টিগ বলল, স্যর, আমি আমার দাদু ও দিদিমার কাছে থাকব। প্রয়োজন হলে খবর দেবেন।
অ্যাঁ? ও, আচ্ছা, ঠিক আছে। পরে দেখা হবে।
এডওয়ার্ড জনের হাত ধরে এগিয়ে গেল একটা বাড়ির দিকে।–মনে পড়ছে বাড়িটা?
আরেব্বাস! আয় তো দেখি, কে আগে পৌঁছতে পারে!
দুজনে দৌড়ল। চারপাশের গাছ, পায়ের নীচের মাটি দ্রুত পিছিয়ে পড়ল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এডওয়ার্ডেরই জয় হল। বাড়িটা ঝড়ের মতো এগিয়ে এসেছে সামনে। –পারলি না, দেখলি তো! বলল এডওয়ার্ড। আমার যে বয়স হয়ে গেছে রে, বলল জন। তবে এটা মনে আছে যে কোনও দিনই তোর সঙ্গে দৌড়ে পারিনি।
দরজার মুখে মা, স্নেহময়ী মা, সেই দোহারা গড়ন। মুখে উজ্জ্বল হাসি। তাঁর পিছনে বাবা, চুলে ছাই রঙের ছোপ, হাতে পাইপ।
মা! বাবা!
শিশুর মতো হাত বাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে এগিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন জন ব্ল্যাক।
দুপুরটা কাটল চমৎকার। খাওয়ার পর জন তাঁর রকেট, অভিযানের গল্প করলেন আর সবাই সেটা উপভোগ করলেন। জন দেখলেন যে তাঁর মা একটুও বদলাননি, আর বাবাও ঠিক আগের। মতো করেই দাঁত দিয়ে চুরুটের ডগা ছিঁড়ে কুঞ্চিত করে দেশলাই সংযোগ করছেন। রাত্রে টার্কির মাংস ছিল। টার্কির পা থেকে মাংসের শেষ কণাটুকু চিবিয়ে খেয়ে ক্যাপ্টেন জন পরম তৃপ্তি অনুভব করলেন। বাইরে গাছপালায় আকাশে মেঘে রাত্রির রঙ, ঘরের মধ্যে ল্যাম্পগুলোকে ঘিরে গোলাপি আভা। পাড়ায় আরও অন্য শব্দ শোনা যাচ্ছে–গানের শব্দ, পিয়ানোর শব্দ, দরজা-জানালা খোলা ও বন্ধ করার শব্দ।
মা গ্রামোফোনে একটা রেকর্ড চাপিয়ে নতুন করে ফিরে পাওয়া ছেলের সঙ্গে একটু নাচলেন। মার গায়ে সেই সেন্টের গন্ধ। এ গন্ধ সে দিনও ছিল, যে দিন ট্রেন দুর্ঘটনায় বাপ-মা দুজনেরই একসঙ্গে মৃত্যু হয়। জন যে মা-কে জড়িয়ে ধরে নাচছে, সেটা যে খাঁটি–সেটা জন বেশ বুঝতে পারছে। মা নাচতে নাচতেই বললেন, ব তো জন, দ্বিতীয়বার জীবনধারণের সুযোগ কজনের আসে?
কাল সকালে ঘুম ভাঙবে, আক্ষেপের সুরে বলল জন, তার কিছু পরেই রকেটে করে আমাদের এই স্বর্গরাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে।
ও রকম ভেবো না, বললেন মা। কোনও অভিযোগ রেখো না মনে। ঈশ্বর যা করেন, মঙ্গলের জন্য। আমরা তাতেই সুখী।
ঠিক বলেছ, মা।
রেকর্ডটা শেষ হল।
তুমি আজ ক্লান্ত, জনের দিকে পাইপ দেখিয়ে বললেন বাবা। তোমার শোবার ঘর তো রয়েইছে, তোমার পিতলের খাটও রয়েছে।
কিন্তু আগে আমার দলের লোকদের খোঁজ নিতে হবে তো।
কেন?
কেন মানে…ইয়ে, বিশেষ কোনও কারণ নেই। সত্যিই তো। ওরাও হয়তো দিব্যি খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়েছে। একটা রাত ভাল করে ঘুমিয়ে নিলে ওদের বরং লাভই হবে।
গুড নাইট জন, মা তার ছেলের গালে চুমু দিয়ে বললেন। তোমাকে পেয়ে আজ আমাদের কত আনন্দ।
আমারও মন আনন্দে ভরে গেছে।
চুরুট আর সেন্টের গন্ধে ভরা ঘর ছেড়ে জন ব্ল্যাক সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে শুরু করল, তার পিছনে এডওয়ার্ড। দুজনে কথায় মশগুল। দোতলায় পৌঁছে এডওয়ার্ড একটা ঘরের দরজা খুলে দিল। জন দেখল তার পিতলের খাট, দেয়ালে টাঙানো তার স্কুল কলেজের নানা রকম চিহ্ন, সেই সময়কার একটা অতিপরিচিত র্যাকুনের লোমের কোট, যাতে হাত না বুলিয়ে পারল না জন। এ যেন বাড়াবাড়ি, বললেন জন। সত্যি, আমার আর অনুভবের শক্তি নেই। দুদিন সমানে বৃষ্টিতে ভিজলে শরীরের যা অবস্থা হয়, আমার মনটা তেমনই সপসপে হয়ে আছে অজস্র বিচিত্র অনুভূতিতে।
এডওয়ার্ড তার নিজের বিছানায় ও বালিশে দুটো চাপড় মেরে জানালার কাচটা উপরে তুলে দিতে জ্যাসমিন ফুলের গন্ধে ঘরটা ভরে গেল। বাইরে চাঁদের আলো। দূরে কাদের বাড়িতে যেন নাচ-গান হচ্ছে।
তা হলে এটাই হল মঙ্গল গ্রহ, তাঁর পোশাক ছাড়তে ছাড়তে বললেন জন ব্ল্যাক।
এডওয়ার্ডও শোবার জন্য তৈরি হচ্ছে। শার্ট খুলে ফেলতেই তার সুঠাম শরীরটা বেরিয়ে পড়ল।
এখন ঘরের বাতি নেবানো হয়ে গেছে। দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছে বিছানায়। কত বছর পরে আবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের মন নানান চিন্তায় ভরপুর।
হঠাৎ তাঁর ম্যারিলিনের কথা মনে হল।
ম্যারিলিন কি এখানে?
জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় শোওয়া এডওয়ার্ড কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে উত্তরটা দিল।
সে এখানেই থাকে, তবে এখন শহরের বাইরে। কাল সকালেই ফিরবে।
ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক চোখ বন্ধ করে প্রায় আপনমনেই বললেন, ম্যারিলিনের সঙ্গে একটিবার দেখা হলে বেশ হত।
ঘরটায় এখন কেবল দুজনের নিশ্বাসের শব্দ।
গুড নাইট, এড।
সামান্য বিরতির পর উত্তর এল, গুড নাইট, জন।
জন ব্ল্যাক নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে ভাবতে লাগলেন।
এখন দেহ-মনে আর অবসাদ নেই, মাথাও পরিষ্কার। এতক্ষণ নানান পরস্পরবিরোধী অনুভূতি তাকে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে দিচ্ছিল না। কিন্তু এখন…।
প্রশ্ন হচ্ছে–কীভাবে এটা সম্ভব হল? এবং এর কারণ কী? শুধুই কি ভগবানের লীলা! ভগবান কি তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এত চিন্তা করেন?
হিংস্টন ও লাস্টিগের কথাগুলো তাঁর মনে পড়ল। নানান যুক্তি, নানান কারণ তাঁর মনের অন্ধকারে আলেয়ার আলোর মতো জেগে উঠতে লাগল। মা। বাবা। এডওয়ার্ড। মঙ্গল। পৃথিবী। মঙ্গলগ্রহের অধিবাসী…