এটা যে রক্তমাংসের হাত, তাতে কোনও সন্দেহ আছে কী?
বাধ্য হয়েই ব্ল্যাককে মাথা নেড়ে স্বীকার করতে হল যে নেই।
তাই যদি হয়, বৃদ্ধা বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, তা হলে আর সন্দেহ কেন?
আসল ব্যাপারটা হচ্ছে কি, মঙ্গল গ্রহে এসে এমন একটা ঘটনা ঘটবে, সেটা আমরা ভাবতেই পারিনি।
কিন্তু এখন তো আর সন্দেহের কোনও কারণ নেই, বললেন মহিলা। আমার বিশ্বাস প্রত্যেক গ্রহেই ভগবানের লীলার নানান নিদর্শন রয়েছে।
এই জায়গাকে কি তা হলে স্বর্গ বলা চলে? হিংস্টন প্রশ্ন করল।
মোটেই না। এটা একটা গ্রহ এবং এখানে আমাদের দ্বিতীয়বার বাঁচার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। সেটা কেন দেওয়া হয়েছে, তা কেউ আমাদের বলেনি। কিন্তু তাতে কী এসে গেল? পৃথিবীতেই বা কেন আমরা ছিলাম তার কারণ তো কেউ বলেনি। আমি অবিশ্যি সেই অন্য পৃথিবীর কথা বলছি–যেখান থেকে তোমরা এসেছ। সেটার আগেও যে আর একটা পৃথিবীতে আমরা ছিলাম না, তার প্রমাণ কোথায়?
তা বটে। বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক।
লাস্টিগ এখনও হাসিমুখে চেয়ে রয়েছে তার দাদু-দিদিমার দিকে। তোমাদের দেখে যে কী ভাল লাগছে!
ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক উঠে পড়লেন।
এবার তা হলে আমাদের যেতে হয়। আপনাদের আতিথেয়তার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
আবার আসবে তো? বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা একসঙ্গে প্রশ্ন করলেন। রাত্রের খাওয়াটা এখানেই হোক না?
দেখি, চেষ্টা করব। কাজ রয়েছে অনেক। আমার লোকেরা রকেটে রয়েছে, আর
ক্যাপ্টেনের কথা থেমে গেল। তাঁর অবাক দৃষ্টি বাইরের দরজার দিকে। দূর থেকে সমবেত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। অনেকে সোল্লাসে কাদের যেন স্বাগত জানাচ্ছে।
ব্ল্যাক দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দূরে রকেটটা দেখা যাচ্ছে। দরজা খোলা, ভিতরের লোক সব বাইরে বেরিয়ে এসেছে। সবাই হাত নাড়ছে আনন্দে। রকেটটাকে ঘিরে মানুষের ভিড়, আর তাদের মধ্য দিয়ে ব্যস্তভাবে ঘোরাফেরা করছে রকেটের তেরোজন যাত্রী। জনতার উপর দিয়ে যে একটা ফুর্তির ঢেউ বয়ে চলেছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
এরই মধ্যে একটা ব্যান্ড বাজতে শুরু করল। তার সঙ্গে ছোট ছোট মেয়েদের সোনালি চুল দুলিয়ে নাচ, হুররে! হুররে! ছোট ঘোট ছেলেরা চেঁচিয়ে উঠল। বুড়োরা এ-ওকে চুরুট বিলি করে তাদের মনের আনন্দ প্রকাশ করল।
এরই মধ্যে মেয়র সাহেব একটি বক্তৃতা দিলেন। তার পর রকেটের তেরোজন প্রত্যেকে তাদের খুঁজে-পাওয়া আত্মীয়-স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল।
ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক আর থাকতে পারলেন না। সমস্ত শব্দ ছাপিয়ে তাঁর চিৎকার শোনা গেল, কোথায় যাচ্ছ তোমরা?
ব্যান্ডবাদকেরাও চলে গেল। এখন আর রকেটের পাশে লোক নেই, সেটা ঝলমলে রোদে পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
দেখেছ কাণ্ড, বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক। রকেটটাকে ছেড়ে চলে গেল! ওদের ছাল-চামড়া তুলে নেব আমি। আমার হুকুম অগ্রাহ্য করে
স্যর, ওদের মাফ করে দিন, বলল লাস্টিগ। এত পুরনো চেনা লোকের দেখা পেয়েছে ওরা।
ওটা কোনও অজুহাত নয়!
কিন্তু জানলা দিয়ে বাইরে চেনা লোক দেখলে তখন ওদের মনের অবস্থাটা কল্পনা করুন!
কিন্তু তাই বলে হুকুম মানবে না?
এই অবস্থায় আপনার নিজের মনের অবস্থা কী হত সেটাও ভেবে দেখুন!
আমি কখনই হুকুম অগ্রাহ্য–
ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হল না। বাইরে রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে আসছে একটি দীর্ঘাঙ্গ যুবক, বছর পঁচিশ বয়স, তার অস্বাভাবিক রকম নীল চোখ দুটো হাসিতে উজ্জ্বল।
জন! যুবকটি এবার দৌড়ে এল ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের দিকে।
এ কী ব্যাপার। ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের যেন স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।
জন! তুই ব্যাটা এখানে হাজির হয়েছিস?
যুবকটি ক্যাপ্টেনের হাত চেপে ধরে তার পিঠে একটা চাপড় মারল।
তুই! অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন এল ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের মুখ থেকে।
তোর এখনও সন্দেহ হচ্ছে?
এডওয়ার্ড! ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক এবার লাস্টিগ ও হিংস্টনের দিকে ফিরলেন, আগন্তুকের হাত তাঁর হাতের মুঠোর মধ্যে।
এ হল আমার ছোট ভাই এডওয়ার্ড। এড–ইনি হলেন হিংস্টন, আর ইনি লাস্টিগ।
দুই ভাইয়ে কিছুক্ষণ হাত ধরে টানাটানির পর সেটা আলিঙ্গনে পরিণত হল।
এড!
জন–হতচ্ছাড়া, তোকে যে আবার কোনও দিন দেখতে পাব–! তুই তো দিব্যি আছিস, এড। কিন্তু ব্যাপারটা কী বল তো? তোর যখন ছাব্বিশ বছর বয়স, তখন তোর মৃত্যু হয়। আমার বয়স তখন উনিশ। কত কাল আগের কথা–আর আজ…
মা অপেক্ষা করছেন, হাসিমুখে বলল এডওয়ার্ড ব্ল্যাক।
মা!
বাবাও!
বাবা! ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক যেন মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। তাঁর গতি টলায়মান।–মাবাবা বেঁচে আছেন? কোথায়?
আমাদের সেই পুরনো বাড়ি। ওক নোল অ্যাভিনিউ!
সেই পুরনো বাড়ি। ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের দৃষ্টি উদ্ভাসিত।
শুনলে তোমরা? হিংস্টন ও লাস্টিগের দিকে ফিরলেন জন ব্ল্যাক। কিন্তু হিংস্টন আর নেই। সে তার নিজের ছেলেবেলার বাসস্থানের দেখা পেয়ে সেই দিকে ছুটে গেছে। লাস্টিগ হেসে বলল, এইবার বুঝেছেন ক্যাপ্টেন–আমাদের বন্ধুদের আচরণের কারণটা? হুকুম মানার অবস্থা ওদের ছিল না।
বুঝেছি, বুঝেছি! জন ব্ল্যাক চোখ বন্ধ করে বললেন। যখন চোখ খুলব তখন কি আবার দেখব তুই আর নেই? জন চোখ খুললেন। না তো! তুই তো এখনও আছিস। আর কী খোলতাই হয়েছে তোর চেহারা।