হিংস্টন বলল, আমাদের কথা এখানে কে বিশ্বাস করবে? শেষকালে কী অবস্থায় পড়তে হবে কে জানে! তার চেয়ে ফিরে গেলে হয় না?
না। অন্তত আর একটা বাড়িতে অনুসন্ধান করার আগে নয়।
তিনজনে আবার রওনা দিয়ে তিনটে বাড়ির পরে ওক গাছের তলায় একটা ছোট্ট বাড়ির সামনে দাঁড়াল।
রহস্যের সন্ধান যুক্তিসম্মত ভাবেই হবে, বললেন, ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক, কিন্তু সে যুক্তির নাগাল আমরা এখনও পাইনি। আচ্ছা, হিংস্টন ধরা যাক তুমি যেটা বলেছিলে, সেটাই ঠিক; অর্থাৎ মহাকাশ ভ্রমণ বহুঁকাল আগেই শুরু হয়েছে, ধরা যাক পৃথিবীর লোকে এখানে এসে থাকার কিছুদিন পরেই তাদের নিজেদের এহের জন্য তাদের মন ছটফট করতে শুরু করেছিল। সেটা ক্রমে অসহ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় একজন মনোবিজ্ঞানী হলে তুমি কী করতে?
হিংস্টন কিছুক্ষণ ভেবে বললে, আমি মঙ্গল গ্রহের জীবনযাত্রাকে ক্রমে বদলিয়ে পৃথিবীর মতন। করে আনতাম। যদি এক গ্রহের গাছপালা নদ-নদী মাঠ-ঘাটকে অন্য আর-এক গ্রহের মতো রূপ দেওয়া সম্ভব হত, তা হলে আমি তাই করতাম। তারপর শহরের সমস্ত লোককে একজোটে হিপনোসিসের সাহায্যে বুঝিয়ে দিতাম যে, তারা যেখানে রয়েছে সেটা আসলে পৃথিবী, মঙ্গল গ্রহ নয়।
ঠিক বলেছ হিংস্টন। এটাই যুক্তিসম্মত কথা। ওই মহিলার ধারণা, তিনি পৃথিবীতেই রয়েছেন। এই বিশ্বাসে তিনি নিশ্চিন্ত। ওঁর মতো এই শহরের প্রত্যেকটি অধিবাসী এক বিরাট মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ভ্রান্ত বিশ্বাসে দিন কাটাচ্ছে।
আমি এ-বিষয়ে সম্পূর্ণ একমত। বলল লাস্টিগ।
আমিও। বলল হিংস্টন।
ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। যাক, এতক্ষণে কিছুটা সোয়াস্তি বোধ করছি। রহস্যের একটা কিনারা হল। সময়ে এগিয়ে। পেছিয়ে যাওয়ার ধারণাটা আমার মোটেই ভাল লাগছিল না। কিন্তু এইভাবে ভাবতে বেশ ভাল লাগছে।ক্যাপ্টেনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। আমার তো মনে হচ্ছে, এবার আমরা নিশ্চিন্তে এদের কাছে আত্মপ্রকাশ করতে পারি।
তাই কি? বলল লাগি। ধরুন যদি এরা এখানে এসে থাকে পৃথিবী থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্দেশ্যে। আমরা পৃথিবীর তোক জানলে এরা খুশি নাও হতে পারে।
আমাদের অস্ত্রের শক্তি অনেক বেশি। চলো দেখি, সামনের বাড়ির লোকে কী বলে?
কিন্তু মাঠটা পেয়োনোর আগেই লাস্টিগের দৃষ্টি হঠাৎ রুখে গেল সামনের রাস্তার একটা অংশে।
স্যার–
কী হল লাস্টিগ?
স্যার, এ কী দেখছি চোখের সামনে। লাস্টিগের দৃষ্টি উদ্ভাসিত, তার চোখে জল। সে যেন তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে এই মুহূর্তেই আনন্দের আতিশয্যে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলবে। সে বেসামাল ভাবে হোঁচট খেতে খেতে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল।
কোথায় যাচ্ছ তুমি? ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক সঙ্গে সঙ্গে তার পশ্চাদ্ধাবন করলেন।
লাস্টিগ দৌড়ে গিয়ে একটা বাড়ির বারান্দায় উঠে পড়ল। বাড়ির ছাতে একটা লোহার মোরগ।
তারপর শুরু হল দরজায় ধাক্কার সঙ্গে চিৎকার। হিংস্টন ও ক্যাপ্টেন ততক্ষণে তার কাছে পৌঁছে গেছে। দুজনেই ক্লান্ত।
দাদু! দিদিমা! দিদিমা! চেঁচিয়ে চলেছে লাস্টিগ।
বারান্দার দরজার মুখে এসে দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা। তাঁরা দুজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন–ডেভিড। তারপর তাঁরা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন লাস্টিকে।
ডেভিড! কত বড় হয়ে গেছিস তুই! ওঃ, কতদিন পরে দেখছি তোকে! তুই কেমন আছিস?
ডেভিড লাস্টিগ কান্নায় ভেঙে পড়েছে। দাদু! দিদিমা! তোমরা তো দিব্যি আছে। বার বার বুড়োবুড়িকে জড়িয়ে ধরেও যেন লাস্টিগের আশ মেটে না। বাইরে সূর্যের আলো, মন-মাতানো হাওয়া, সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ আনন্দের ছবি।
ভেতরে আয়! বরফ দেওয়া চা আছে–অফুরন্ত।
আমার দুই বন্ধু সঙ্গে আছে দিদিমা। লাস্টিগ দুজনের দিকে ফিরে বলল, উঠে আসুন আপনারা।
এসো ভাই এসো, বললেন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা। ভিতরে এসো। ডেভিডের বন্ধু মানে তো আমাদেরও বন্ধু। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?
বৈঠকখানাটা দিব্যি আরামের। ঘরের এক কোণে একটা গ্র্যান্ডফাদার ক্লক চলছে টিক টিক করে, চারিদিকে সোফার উপর নরম তাকিয়া, দেওয়ালের সামনে আলমারিতে বইয়ের সারি, মেঝেতে গোলাপের নকশায় ভরা পশমের গালিচা। সকলের হাতেই এখন গেলাসের বরফ-চা তাদের তৃষ্ণা উপশম করছে।
তোমাদের মঙ্গল হোক। বৃদ্ধা তাঁর হাতের গেলাসটা ঠোঁটে ঠেকালেন।
তোমরা এখানে কদিন আছ? লাস্টিগ প্রশ্ন করল।
আমাদের মৃত্যুর পর থেকেই। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বললেন মহিলা।
কীসের পর থেকে? ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের হাতের গেলাস টেবিলে নেমে গেছে।
ওঁরা মারা গেছেন প্রায় ত্রিশ বছর হল, বলল লাস্টিগ।
আর সে কথাটা তুমি অম্লানবদনে উচ্চারণ করলে? ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক চেঁচিয়ে উঠলেন।
বৃদ্ধা উজ্জ্বল হাসি হেসে চাইলেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের দিকে, তাঁর দৃষ্টিতে মৃদু ভর্ৎসনা। কখন কী ঘটে, তা কে বলতে পারে বলে। এই তো আমরা রয়েছি এখানে। জীবনই বা কী আর মৃত্যুই বা কী, তা কে বলবে? আমরা শুধু জানি যে, আমরা আবার বেঁচে উঠেছি। বলতে পারো আমাদের একটা দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বৃদ্ধা উঠে গিয়ে ক্যাপ্টেনের সামনে তাঁর ডান হাতটা এগিয়ে দিলেন। ধরে দেখো। ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক বৃদ্ধার কবজির উপর হাত রাখলেন।