তারা এখানেই এসে বসবাস শুরু করে, হিংস্টন বলে চলল, এবং যেহেতু তাদের রুচি, তাদের সংস্কৃতি তারা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল, তাই তাদের বসবাসের পরিবেশও তৈরি করে নিয়েছিল পৃথিবীর মতো করেই।
তুমি বলতে চাও, তারাই এতদিন এখানে বসবাস করছে?
হ্যাঁ, এবং পরম শান্তিতে। হয়তো তারা আরও বার কয়েক পৃথিবীতে ফিরে গিয়েছিল আরও লোকজন সঙ্গে করে আনার জন্য। একটা ছোট শহরে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে, এমন সংখ্যক লোক এনে তারা যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছিল। পৃথিবীর লোকে তাদের কীর্তি জেনে ফেলে এটা নিশ্চয়ই তারা চায়নি। এই কারণেই এই শহরের চেহারা এত প্রাচীন। এ শহর ১৯২৭-এর পর আর এক দিনও এগিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তাই নয় কি? অথবা এমনও হতে পারে যে, মহাকাশ অভিযান ব্যাপারটা আমরা যা মনে করছি, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাচীন। হয়তো পৃথিবীর কোনও একটা অংশে কয়েকজনের চেষ্টায় এটার সূত্রপাত হয়েছিল। তাদের লোক হয়তো মাঝে মাঝে পৃথিবীতে ফিরে গেছে।
তোমার যুক্তি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে।
হতেই হবে স্যার। প্রমাণ আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। এখন শুধু দরকার এখানকার কিছু লোকের সাক্ষাৎ পাওয়া।
পুরু ঘাসের জন্য তিনজনের হাঁটার শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। ঘাসের গন্ধ তাজা। ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের মনে যতই সন্দেহ থাকুক না কেন, একটা পরম শান্তির ভাব তাঁর দেহ-মন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ত্রিশ বছর পরে তিনি এমন একটা শহরে এলেন। মৌমাছির মৃদু গুঞ্জন তাঁর মনে একটা প্রসন্নতা এনে দিয়েছিল। আর পরিবেশের সুস্থ সবলতা তাঁর আত্মাকে পরিতুষ্ট করছিল।
তিনজনেই বাড়িটার সামনের বারান্দায় গিয়ে উঠল। দরজার দিকে এগোনোর সময়ে কাঠের মেঝেতে ভারী বুটের শব্দ হল। ভিতরের ঘরটা এখন দেখা যাচ্ছে। একটা পুঁতির পরদা ঝুলছে। উপরে একটা ঝাড়লণ্ঠন। দেওয়ালে ঝুলছে ঊনবিংশ শতাব্দীর এক জনপ্রিয় শিল্পীর আঁকা একটা বাঁধানো ছবি। ছবির নীচে একটা চেনা ঢঙের আরাম কেদারা। শব্দও শোনা যাচ্ছে–জাগের জলের বরফের টুং টাং। ভিতরের রান্নাঘরে কে যেন পানীয় প্রস্তুত করছে। সেইসঙ্গে নারীকণ্ঠে গুনগুন করে গাওয়া একটি গানের সুর।
ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক কলিং বেল টিপলেন।
ঘরের মেঝের উপর দিয়ে হালকা পায়ের শব্দ এগিয়ে এল। একটি বছর চল্লিশেকের মহিলা–যাঁর পরমে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের পোশাক–পরদা ফাঁক করে তিনজন পুরুষের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলেন।
আপনারা?
কিছু মনে করবেন না। ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের কণ্ঠস্বরে অপ্রস্তুত ভাব–আমরা,–মানে এ ব্যাপারে আপনি কোনও সাহায্য করতে পারেন কিনা…
ভদ্রমহিলা অবাক দৃষ্টিতে দেখলেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাকের দিকে।
আপনারা কি কিছু বিক্রিটিক্রি করতে এসেছেন?
না–না! ইয়ে…এই শহরের নামটা যদি–
তার মানে? মহিলার ভ কুঞ্চিত। এখানে এসেছেন আপনারা, অথচ এই শহরের নাম জানেন?
ক্যাপ্টেন বেশ বেকায়দায় পড়ছেন তা বোঝাই যাচ্ছে। বললেন, আসলে আমরা এখানে আগন্তুক। আমরা জানতে চাইছি, এ শহর এখানে এল কী করে, আর আপনারাই বা কী করে এসেছেন?
আপনারা কি সেন্সাস নিতে বেরিয়েছেন?
আজ্ঞে না।
এখানে সবাই জানে যে, এ শহর তৈরি হয়েছিল ১৮৬৮ সালে। আপনারা কি ইচ্ছা করে বোকা সাজছেন?
না–না–মোটেই না, ব্যস্তভাবে বললেন ক্যাপ্টেন, আসলে আমরা আসছি পৃথিবী থেকে।
পৃথিবী?
আজ্ঞে হ্যাঁ। পৃথিবী। সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ। রকেটে করে এসেছি আমরা। আমাদের লক্ষ্যই ছিল চতুর্থ গ্রহ মঙ্গল।
মহিলা যেন কতগুলি শিশুকে বোঝাচ্ছেন, এইভাবে উত্তর দিলেন, এই শহর হল ইলিনয়ে। নাম গ্রিন ব্ল্যাক। আমরা থাকি যে মহাদেশে, তার নাম আমেরিকা। তাকে ঘিরে আছে অতলান্তিক আর প্রশান্ত মহাসাগর। আমাদের গ্রহের নাম পৃথিবী। আপনারা এখন আসতে পারেন। গুডবাই।
ভদ্রমহিলা বাড়ির ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
তিনজন হতভম্বভাবে পরস্পরের দিকে চাইল।
লাস্টিগ বলল, চলুন, সোজা ভিতরে গিয়ে ঢুকি।
সে হয় না। এটা প্রাইভেট প্রপার্টি। কিন্তু কী আপদ রে বাবা!
তিনজন বারান্দার সিঁড়িতে বসল।
ব্ল্যাক বললেন, এমন একটা কথা কি তোমাদের মনে হয়েছে যে, আমরা হয়তো ভুল পথে আবার পৃথিবীতেই ফিরে এসেছি?
সেটা কী করে সম্ভব? বলল লাস্টিগ।
জানি না! তা জানি না! মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবার শক্তি দাও। হে ভগবান!
হিংস্টন বলল, আমরা সমস্ত রাস্তা হিসাব করে এসেছি। আমাদের ক্রোনোমিটার প্রতি মুহূর্তে বলে দিয়েছে, আমরা কতদূর অগ্রসর হচ্ছি। চাঁদ পেরিয়ে আমরা মহাকাশে প্রবেশ করি। এটা মঙ্গল গ্রহ হতে বাধ্য।
লাস্টিগ বলল, ধরো যদি দৈবদুর্বিপাকে আমাদের সময়ের গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছে–আমরা ত্রিশ চল্লিশ বছর আগের পৃথিবীতে ফিরে এসেছি?
তোমার বকবকানি বন্ধ করো তো লাস্টিগ! অসহিষ্ণুভাবে বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক।
লাস্টিগ উঠে গিয়ে আবার কলিং বেল টিপল। ভদ্রমহিলার পুনরাবির্ভাব হতে সে প্রশ্ন করল, এটা কোন সাল?
এটা যে উনিশশো ছাব্বিশ, সেটাও জানেন না?
ভদ্রমহিলা ফিরে গিয়ে একটা দোলনা-চেয়ারে বসে লেমনেড খেতে শুরু করলেন।
শুনলেন তো? লাস্টিগ ফিরে এসে বলল। উনিশশো ছাব্বিশ। আমরা সময়ে পিছিয়ে গেছি। এটা পৃথিবী।
লাস্টিগ বসে পড়ল। তিনজনেরই মনে এখন গভীর উদ্বেগ। হাঁটুর উপর রাখা তাদের হাতগুলো আর স্থির থাকছে না। ক্যাপ্টেন বললেন, এমন একটা অবস্থায় পড়তে হবে, সেটা কি আমরা ভেবেছিলাম? এ কী ভয়াবহ পরিস্থিতি! এমন হয় কী করে? আমাদের সঙ্গে আইনস্টাইন থাকলে হয়তো এর একটা কিনারা করতে পারতেন!