লাস্টিগ বলল, এটা ভুললে চলবে না যে, ইয়র্ক ও উইলিয়াস নেমেছিল মঙ্গলের উলটোপিঠে। আমরা ইচ্ছে করেই এ পিঠ বেছে নিয়েছি।
ঠিক কথা, বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক। হিংস্র মঙ্গলবাসীদের হাতে যদি ইয়র্ক ও উইলিয়ামসের দলের মৃত্যু হয়ে থাকে, তাই আমাদের বলা হয়েছিল ল্যান্ডিং-এর জন্য অন্য জায়গা বেছে নিতে, যাতে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। তাই আমরা নেমেছি এমন একটি জায়গায়, যার সঙ্গে ইয়র্ক বা উইলিয়ামসের কোনও পরিচয়ই হয়নি।
হিংস্টন বলল, যাই হোক, আমি আপনার অনুমতি নিয়ে শহরটা একবার ঘুরে দেখতে চাই। এমনও হতে পারে যে, দুই গ্রহ ঠিক একই সঙ্গে একই নিয়মের মধ্যে গড়ে উঠেছে। একই সৌরজগতের গ্রহে হয়তো এটা সম্ভব। হয়তো আমরা এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি।
আমার মতে আর একটুক্ষণ অপেক্ষা করা উচিত। হয়তো এই আশ্চর্য ঘটনাই সর্বপ্রথম ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করবে।
ঈশ্বরের বিশ্বাসের জন্য এমন একটা ঘটনার কোনও প্রয়োজন হয় না, হিংস্টন।
আমি নিজেও ঈশ্বরে বিশ্বাসী, বলল হিংস্টন, কিন্তু এমন একটা শহর ঈশ্বরের ইচ্ছা ব্যতীত গড়ে উঠতে পারে না। শহরের প্রতিটি খুঁটিনাটি লক্ষ করুন। আমি তো সব কি কাঁদব বুঝতে পারছি না।
আসল রহস্যটা কী, সেটা জানার আগে হাসি কান্না কোনওটারই প্রয়োজন নেই।
লাস্টিগ এবার মুখ খুলল।
রহস্য? দিব্যি মনোরম একটি শহর, তাতে আবার রহস্য কী? আমার তো নিজের জন্মস্থানের কথা মনে পড়ছে।
তুমি কবে জন্মেছিলে লাস্টিগ? ব্ল্যাক প্রশ্ন করলেন।
১৯৫০ সালে, স্যার।
আর তুমি, হিংস্টন?
১৯৫৫। আমার জন্ম আইওয়ার গ্রিনেল শহরে। এই শহরটাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি আমার জন্মস্থানে ফিরে এসেছি।
তোমাদের দুজনেরই বাপের বয়সী আমি, বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক। আমার বয়স আশি। ইলিনয়ে ১৯২০ সালে আমার জন্ম। বিজ্ঞানের দৌলতে গত পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধদের নবযৌবন দান করার উপায় আবিষ্কার হয়েছে। তার জোরেই আমি আজ মঙ্গল গ্রহে আসতে পেরেছি, এবং এখনও ক্লান্তি বোধ করছি না। কিন্তু আমার মনে সন্দেহের মাত্রা তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি। এই শান্ত শহরের চেহারার সঙ্গে ইলিনয়ের গ্রিন ক্লাফ শহরের এত বেশি মিল যে, আমি অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছি। এত মিল স্বাভাবিক নয়।
কথাটা বলে ব্ল্যাক রেডিও অপারেটরের দিকে চাইলেন।
শোনো–পৃথিবীতে খবর পাঠাও। বলল যে, আমরা মঙ্গল গ্রহে ল্যান্ড করেছি। এইটুকু বললেই হবে। বলল, কালকে বিস্তারিত খবর পাঠাব।
তাই বলছি স্যার।
ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক এখনও চেয়ে আছেন শহরটার দিকে। তাঁর চেহারা দেখলে তাঁর আসল বয়সের অর্ধেক বলে মনে হয়। এবার তিনি বললেন, তা হলে যেটা করা যেতে পারে, সেটা হচ্ছে। এইলাস্টিগ, হিংস্টন আর আমি একবার নেমে ঘুরে দেখে আসি। অন্যেরা রকেটেই থাকুক; যদি প্রয়োজন হয়, তখন তারা বেরোতে পারে। কোনও গোলমাল দেখলে তারা এর পরে যে রকেটটা আসার কথা আছে, সেটাকে সাবধান করে দিতে পারে। এর পর ক্যাপ্টেন ওয়াইলডারের আসার কথা। আগামী ডিসেম্বরে রওনা হবেন। যদি মঙ্গল গ্রহে সত্যিই অমঙ্গল কিছু থাকে, তা হলে তাদের সে বিষয়ে তৈরি হয়ে আসতে হবে।
আমরাও তো সে ব্যাপারে তৈরিই আছি। আমাদের তো অস্ত্রের অভাব নেই।
তা হলে সকলে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকুক।–চলো, আমরা নেমে পড়ি।
তিনজন পুরুষ রকেটের দরজা খুলে নীচে নেমে গেল।
দিনটা চমৎকার। তার উপর আবার বসন্তকালের সব লক্ষণই বর্তমান। একটি রবিন পাখি ফুলে ভরা আপেল গাছের ডালে বসে আনমনে গান গাইছে। মৃদুমন্দ বাতাসে ফুলের পাপড়ি মাঝে মাঝে ঝরে পড়ছে মাটিতে। ফুলের গন্ধও ভেসে আসছে সেই সঙ্গে। কোথা থেকে যেন পিয়ানোর মৃদু টুং-টাং শোনা যাচ্ছে, আর সেইসঙ্গে অন্য কোনও বাড়ি থেকে ভেসে আসছে সেই আদ্যিকালের চোঙাওয়ালা গ্রামোফোনে বাজানো আদ্যিকালের প্রিয় গাইয়ে হ্যারি লডারের গান।
তিনজন কিছুক্ষণ রকেটের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর তারা হাঁটতে শুরু করল খুব সাবধানে, কারণ বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ পৃথিবীর চেয়ে কিছু কম, তাই বেশি পরিশ্রম করা চলবে না।
এবারে গ্রামোফোনের রেকর্ড বদলে গেছে। এবার বাজছে, ও, গিভ মি দ্য জুন নাইট।
লাস্টিগের স্নায়ু চঞ্চল। হিংস্টনেরও তাই। পরিবেশ শান্ত। দূরে কোথা থেকে যেন একটা জলের কুল কুল শব্দ আসছে, আর সেইসঙ্গে একটা ঘোড়ায় টানা ওয়াগনের অতি পরিচিত ঘড় ঘড় শব্দ।
হিংস্টন বলল, স্যার, আমার এখন মনে হচ্ছে, মঙ্গল গ্রহে মানুষ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই আসতে আরম্ভ করেছে।
অসম্ভব!
কিন্তু তা হলে এইসব ঘরবাড়ি, এই লোহার হরিণ মূর্তি, এই পিয়ানো, পুরনো রেকর্ডের গান–এগুলোর অর্থ করবেন কী করে? হিংস্টন ক্যাপ্টেনের হাত ধরে গভীর আগ্রহের সঙ্গে তার মুখের দিকে চাইল। ধরুন যদি এমন হয় যে, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কিছু যুদ্ধবিরোধী লোক একজোট হয়ে বৈজ্ঞানিকের সাহায্যে একটা রকেট বানিয়ে এখানে চলে আসে?
সেটা হতেই পারে না, হিংস্টন।
কেন হবে না? তখনকার দিনে পৃথিবীতে ঢাক না পিটিয়ে গোপনে কাজ করার অনেক বেশি সুযোগ ছিল।
কিন্তু রকেট জিনিসটা তো আর মুখের কথা নয়! সেটা নিয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করা তখনকার দিনেও অসম্ভব হত।