ডাক্তার জে হার্ডকালের ডায়রির শেষ এখানেই।
দি টেরর অফ ব্লু জন গ্যাপ
সন্দেশ, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৪
মঙ্গলই স্বর্গ
মহাকাশ থেকে রকেটটা নেমে আসছে তার গন্তব্যস্থলের দিকে। এতদিন সেটা ছিল তারায় ভরা নিঃশব্দ নিকষ কালো মহাশুন্যে একটি বেগবান ধাতব উজ্জ্বলতা। অগ্নিগর্ভ রকেটটা নতুন। এর দেহ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে উত্তাপ। এর কক্ষের মধ্যে আছে মানুষ ক্যাপ্টেন সমেত সতেরোজন। ওহাইয়ো থেকে রকেটটা যখন আকাশে ওঠে, তখন অগণিত দর্শক হাত নাড়িয়ে এদের শুভযাত্রা কামনা করেছিল। প্রচণ্ড অগ্নদগারের সঙ্গে সঙ্গে রকেটটা সোজা উঠে ছুটে গিয়েছিল মহাশূন্যের দিকে। মঙ্গল গ্রহকে লক্ষ্য করে এই নিয়ে তৃতীয়বার রকেট অভিযান।
এখন রকেট মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করেছে। তার গতি ক্রমশ কমে আসছে। এই মন্থর অবস্থাতেও তার শক্তির পরিচয় সে বহন করছে। এই শক্তিই তাকে চালিত করেছে মহাকাশের কৃষ্ণসাগরে। চাঁদ পোনোর পরেই তাকে পড়তে হয়েছিল অসীম শূন্যতার মধ্যে। যাত্রীরা নানান প্রতিকূল অবস্থায় বিধ্বস্ত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠেছিল। একজনের মৃত্যু হয়। বাকি ষোলোজন এখন স্বচ্ছ জানলার ভিতর দিয়ে বিমুগ্ধ চোখে মঙ্গলের এগিয়ে আসা দেখছে।
মঙ্গল গ্রহ! সোল্লাসে ঘোষণা করল রকেটচালক ডেভিড লাস্টিগ।
এসে গেল মঙ্গল বলল প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যামুয়েল হিংস্টন।
যাক! স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন ক্যাপ্টেন জন ব্ল্যাক।
রকেটটা একটা মসৃণ সবুজ ঘাসে ঢাকা লনের উপর এসে নামল। যাত্রীরা লক্ষ করল, ঘাসের উপর দাঁড়ানো একটি লোহার হরিণের মূর্তি। তারও বেশ কিছুটা পিছনে দেখা যাচ্ছে রোদে ঝলমল একটা বাড়ি, যেটা ভিক্টোরীয় যুগের পৃথিবীর বাড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়। সর্বাঙ্গে বিচিত্র কারুকার্য, জানলায় হলদে নীল সবুজ গোলাপি কাচ। বাড়ির বারান্দার সামনে দেখা যাচ্ছে জেরেনিয়াম গাছ আর বারান্দায় মৃদু বাতাসে আপনিই দুলছে ছাত থেকে ঝোলানো একটি দোলনা। বাড়ির চুড়োয় রয়েছে জানলা সমেত একটি গোল ঘর, যার ছাতটা যেন একটা গাধার টুপি।
রকেটের চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে মঙ্গলের এই শান্ত শহর, যার উপর বসন্ত ঋতুর প্রভাব স্পষ্ট। আরও বাড়ি চোখে পড়ে, কোনওটা সাদা, কোনওটা লাল,–আর দেখা যায় লম্বা এম্ মেপ ও হর্স চেস্টনাট গাছের সারি। গিজাও রয়েছে দু-একটা, যার সোনালি ঘণ্টাগুলো এখন নীরব।
রকেটের মানুষগুলি এ দৃশ্য দেখল। তারপর তারা পরস্পরের দিকে চেয়ে আবার বাইরে দৃষ্টি দিল। তারা সকলেই এ-ওর হাত ধরে আছে, সকলেই নির্বাক, শ্বাস নিতেও যেন ভরসা পাচ্ছে না তারা।
এ কী তাজ্জব ব্যাপার! ফিসফিসিয়ে বলল লাস্টিগ।
এ হতে পারে না! বলল স্যামুয়েল হিংস্টন।
হে ঈশ্বর! বললেন ক্যাপ্টেন জন ব্ল্যাক। রাসায়নিক তাঁর গবেষণাগার থেকে স্পিকারে একটি তথ্য ঘোষণা করলেন–বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন আছে। শ্বাস নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
লাস্টিগ বলল, তা হলে আমরা বেরোই।
দাঁড়াও, দাঁড়াও, বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক, আগে তো ব্যাপারটা বুঝতে হবে।
ব্যাপারটা হল এটি একটি ছোট্ট শহর, যাতে মানুষের শাসের পক্ষে যথেষ্ট অক্সিজেন আছে–ব্যস।
প্রত্নতাত্ত্বিক হিংস্টন বললেন, আর এই শহর একেবারে পৃথিবীর শহরের মতো। এটা একটা অসম্ভব ব্যাপার, কিন্তু তাও সম্ভব হয়েছে।
ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক হিংস্টনের দিকে চেয়ে বললেন, তুমি কি বিশ্বাস করো যে, দুটি বিভিন্ন গ্রহে সভ্যতা ও সংস্কৃতি ঠিক একই সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে গড়ে উঠতে পারে?
সেটা সম্ভব বলে আমার জানা ছিল না।
ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক বাইরের শহরের দিকে চেয়ে বললেন, তোমাদের বলছি শোনো,–জেরেনিয়াম হচ্ছে এমন একটি গাছ, যার অস্তিত্ব পৃথিবীতে পঞ্চাশ বছর আগেও ছিল না। ভেবে দেখো, কত হাজার বছর লাগে একটি উদ্ভিদের আবির্ভাব হতে! এবার তা হলে বলো এটা যুক্তিসম্মত কিনা যে, আমরা মঙ্গল গ্রহে এসে দেখতে পাব–এক, রঙিন কাঁচ বসানো জানলা; দুই, বাড়ির মাথায় গোল ঘরের উপর গাধার টুপি; তিন, বারান্দার ছাত থেকে ঝুলন্ত দোলনা চার, একটি বাদ্যযন্ত্র, যেটা। পিয়ানো ছাড়া আর কিছু হতে পারে না আর পাঁচ–যদি তোমার এই দূরবিনের মধ্যে দিয়ে দেখো তা হলে দেখবে পিয়ানোর উপর একটি গানের স্বরলিপি রয়েছে, যার নাম বিউটিফুল ওহাইয়ো। তার মানে কি মঙ্গলেও একটি নদী আছে, যার নাম ওহাইয়ো?
কিন্তু ক্যাপ্টেন উইলিয়াস কি এর জন্য দায়ী হতে পারেন না?
তার মানে?
ক্যাপ্টেন উইলিয়ামস্ ও তাঁর তিন সহযাত্রী! অথবা ন্যাথেনিয়াল ইয়র্ক ও তাঁর সহযাত্রী। এটা নিঃসন্দেহে এঁদেরই কীর্তি।
এই বিশ্বাস যুক্তিহীন, বললেন ক্যাপ্টেন ব্ল্যাক। আমরা যতদূর জানি ইয়র্কের রকেট মঙ্গলে পৌঁছনোমাত্র ধ্বংস হয়। ফলে ইয়র্ক ও তাঁর সহযাত্রীর মৃত্যু হয়। উইলিয়ামসের রকেট মঙ্গল গ্রহে পোঁছনোর পরের দিন ধ্বংস হয়। অন্তত দ্বিতীয় দিনের পর থেকে তাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর রেডিও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। উইলিয়ামসের দল যদি বেঁচে থাকত, তা হলে তারা নিশ্চয়ই পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করত। ইয়র্ক মঙ্গলে এসেছিল এক বছর আগে, আর উইলিয়ামস্ গত অগস্ট মাসে। ধরো যদি তারা এখনও বেঁচে থাকে, এবং মঙ্গল গ্রহে অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণী বাস করে, তা হলেও কি তাদের পক্ষে এই ক মাসের মধ্যে এমন একটা শহর গড়ে তোলা সম্ভব? শুধু গড়ে তোলা নয়,–সেই শহরের উপর কৃত্রিম উপায়ে বয়সের ছাপ ফেলা সম্ভব? শহরটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এটা অন্তত বছর সত্তরের পুরনো। ওই বাড়ির বারান্দার কাঠের থামগুলো দেখো। গাছগুলোর বয়স একশো বছরের কম হওয়া অসম্ভব। না–এটা ইয়র্ক বা উইলিয়ামসের কীর্তি হতে পারে না। এর রহস্যের চাবিকাঠি খুঁজতে হবে অন্য জায়গায়। আমার কাছে ব্যাপারটা অত্যন্ত গোলমেলে বলে মনে হচ্ছে। এই শহরের অস্তিত্বের কারণ না জানা পর্যন্ত আমি এই রকেট থেকে বেরোচ্ছি না।