যখন জ্ঞান হল, তখন দেখি আমি অ্যালারটনদের বাড়িতে আমার খাটের উপর শুয়ে আছি। রু-জন গ্যাপের ঘটনাটার পর দুদিন কেটে গেছে। মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে, বাঁ পায়ের হাড় ও পাঁজরের দুটো হাড় ভাঙা অবস্থায় আমি সারারাত ওই গুহার মধ্যে পড়ে ছিলাম। পরদিন সকালে আমার লেখা চিঠি খুঁজে পেয়ে জনাদশেক চাষা দল বেঁধে গিয়ে আমায় খুঁজে বার করে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। সেই থেকে সমানে নাকি আমি প্রলাপ বকেছি। জানোয়ার জাতীয় কিছুই নাকি এদের চোখে পড়েনি। আমার বন্দুকের গুলি যে কোনও প্রাণীকে জখম করেছে, তার প্রমাণ হিসাবে কোনও রক্তের চিহ্নও নাকি এরা দেখতে পায়নি। আমার নিজের অবস্থা, এবং জমিতে কিছু অস্পষ্ট দাগ ছাড়া আমার কাহিনীর সত্যতা প্রমাণ করার মতো কিছুই নাকি পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনার পর দেড় মাস কেটে গেছে। আমি এখন বাইরের বারান্দায় বসে রোদ পোয়াচ্ছি। আমার ঠিক সামনেই খাড়া পাহাড়–তার পাংশুটে পাথরের গায়ে ওই যে দেখা যাচ্ছে র-জন সুড়ঙ্গের। মুখ। কিন্তু ওটা আর আমার মনে ভীতিসঞ্চার করে না। আর কোনওদিনও ওই সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে কোনও ভয়ঙ্কর প্রাণী মনুষ্যজগতে হানা দিতে বেরোবে না। বিজ্ঞানবি অথবা বিদ্যাদিগগজ অনেক সম্ভ্রান্ত বাবুরা হয়তো আমার কাহিনীকে হেসে উড়িয়ে দেবেন–কিন্তু এখানকার দরিদ্র সরল গ্রামবাসীরা আমার কথা এক মুহূর্তের জন্যও অবিশ্বাস করেনি। এ সম্পর্কে কালটন কুরিয়ার পত্রিকার মন্তব্য তুলে দিলাম :
আমাদের পত্রিকার, অথবা ম্যাটলক, বাক্সটন ইত্যাদি অঞ্চলের যেসব পত্রিকার সংবাদদাতা উক্ত ঘটনার তদন্ত করিতে আসিয়াছেন, তাহাদের কাহারও পক্ষে গহ্বরে প্রবেশ করিয়া ডাঃ জেস হার্ডকাসলের বিচিত্র কাহিনীর সত্যমিথ্যা বিচার করিবার কোনও উপায় ছিল না। উক্ত ঘটনা সম্পর্কে কী করণীয় তাহা স্থানীয় অধিবাসীগণ নিজেরাই স্থির করিয়া প্রত্যেকেই গুহার প্রবেশদ্বারটি প্রস্তর দ্বারা বন্ধ করিতে তৎপর হইয়াছিল। গহ্বরের সম্মুখস্থ ঢালু রাস্তা দিয়া বৃহৎ বৃহৎ প্রস্তরখণ্ড গড়াইয়া লইয়া সুড়ঙ্গ-দ্বারটি তাহারা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিতে সক্ষম হইয়াছে। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনাটির পরিসমাপ্তি ঘটে এইভাবেই। স্থানীয় বাসিন্দাগণ ঘটনাটি সম্পর্কে বিভিন্ন মত পোষণ করেন। কেহ কেহ বলেন, রুণ অবস্থাই ডাঃ হার্ডকাসূলের মস্তিষ্কবিকৃতি ও তজ্জনিত উদ্ভট কল্পনাদির কারণ। ইহাদের মতে, কোনও ভ্রান্ত অথচ দৃঢ় বিশ্বাস তাঁহাকে গহ্বরে প্রবেশ করিতে বাধ্য করিয়াছিল, এবং গহ্বরের প্রস্তর ভূমিতে পদস্খলন হেতু তিনি আহত হইয়াছিলেন। গহ্বরের ভিতর যে এক অদ্ভুত জীব বাস করে, এরূপ একটা জনপ্রবাদ বহুঁকাল হইতে এই অঞ্চলে প্রচলিত আছে। স্থানীয় কৃষকদিগের বিশ্বাস যে, ডাঃ হার্ডকালের বিবরণ ও তাঁহার দেহের ক্ষত এই প্রবাদকে বাস্তবে পরিণত করিয়াছে। উক্ত ঘটনা। সম্পর্কে ইহার অধিক কিছু মন্তব্য করা সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ইহার সমর্থন আদৌ সম্ভবপর বলিয়া আমরা মনে করি না।
কুরিয়ার পত্রিকা এই মন্তব্যটি প্রকাশ করার আগে একবার আমার সঙ্গে আলাপ করলে বুদ্ধিমানের কাজ করত। আমি অনেক ভেবে ঘটনাটার একটা বৈজ্ঞানিক কারণ অনুমান করে এর অবিশ্বাস্যতা খানিকটা দূর করেছি। অন্তত আমার নিজের অভিজ্ঞতার একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হিসাবে আমি এখানে সেটা পেশ করছি।
আমার মতে (যে মত আমি ঘটনাটা ঘটবার আগেই ডায়েরিতে ইঙ্গিত করেছি) ইংল্যান্ডের এই সব অঞ্চলে ভূগর্ভে বিস্তীর্ণ জলাশয় রয়েছে। পাহাড়ের ফাটল দিয়ে বাইরের জলস্রোত ভিতরে ঢুকেই এইসব জলাশয়ের সৃষ্টি করেছে। জলাশয় থাকলেই বাষ্পের উদ্ভব হয়, এবং বাষ্প থেকে বৃষ্টি ও বৃষ্টি থেকে উদ্ভিদের জন্ম সম্ভব। পৃথিবীর আদি যুগে হয়তো বা এই ভূগর্ভ জগতের সঙ্গে বাইরের জগতের একটা যোগাযোগ ছিল, এবং সেই অবস্থায় হয়তো বাইরের জগতের গাছপালার কিছু বীজ ও তার সঙ্গে কোনও কোনও প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী এই ভূগর্ভজগতে এসে পড়েছিল। এইসব প্রাণীদেরই একটির বংশধর হয়তো এই জানোয়ারকে দেখে মনে হয় আদিম ভাল্লুকের এক বর্ধিত সংস্করণ। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে হয়তো এই ভূগর্ভজগৎ আমাদের পরিচিত জগতের পাশাপাশি একই সঙ্গে অবস্থান করেছে। রোমান সুড়ঙ্গটি খোঁড়ার সময় হয়তো এই ভূগর্ভজগতের কোনও প্রাণী বাইরের জগতের সন্ধান পায়। অন্ধকারবাসী অন্য সব প্রাণীর মতোই এও দৃষ্টিশক্তিহীন জীব। অথচ অন্য সব ইন্দ্রিয় এতই সজাগ যে, চোখের অভাব পূরণ হয়ে যায়। না হলে সে ভেড়ার সন্ধান পাবে কী করে? এরা যে কেবল অন্ধকার রাত্রে চলাফেরা করে, তার কারণ বোধহয়, মণির অভাবে আলো সহ্য হয় না। আমার লণ্ঠনই হয়তো চরম সংকটের মুহূর্তে আমার প্রাণরক্ষা করেছিল। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। এসব তথ্য আমি লিখে গেলাম আপনাদের বিবেচনার জন্য। একে সমর্থন করা সম্ভব কিনা তা আপনারা বিচার করে দেখবেন। যদি মনে হয় সবটাই অবিশ্বাস্য, তা হলেও আমার কিছু বলার নেই। মূল ঘটনা আপনাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের অনেক উর্ধ্বে। আর আমার ব্যক্তিগত মতামতের প্রশ্ন যদি তোলেন, তা হলে বলব যে, তারও আর বিশেষ কোনও মূল্য নেই, কারণ আমার কাজ ফুরিয়ে এল।