এই বসে থাকার যেন আর শেষ নেই। উপত্যকাটার চারদিকে টিপটিপ করছে কৃষকদের বাড়ির বাতিগুলো। দূর থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভেসে আসছে চ্যাপল-লি-ডেল গিজার ঘড়ির ঢং ঢং শব্দ। আশেপাশে অন্য লোকজন যে রয়েছে, তার চিহ্নগুলো যেন আমার একাকিত্বকে আরও করুণ ও দুর্বিষহ করে তুলছিল। এক-এক সময় মনে হচ্ছিল, আমার অভিযানে জলাঞ্জলি দিয়ে সব ছেড়ে-ছুড়ে বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু মানুষের মনে আত্মসম্মান বোধটা এত গভীর ও বদ্ধমূল যে, একটা কোনও সংকল্প নিয়ে একবার অগ্রসর হলে মাঝপথে ফিরে আসা ভারী মুশকিল।
সেই কারণেই সেদিন আমি গহ্বরের মুখ থেকে ফিরে আসতে পারিনি। আর যাই হোক, আমি কাপুরুষ, এ অপবাদ আমাকে কেউ দিতে পারবে না।
দূরের গিজার ঘড়িতে বারোটা বাজল। তারপর একটা, তারপর দুটো। এই সময়টা অন্ধকার সবচেয়ে গভীর। তারাহীন আকাশের নীচ দিয়ে মেঘ ভেসে চলেছে। পাহাড়ের ফাটলে কোথায়। যেন একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। এ ছাড়া শুধু এক ঝিরঝিরে হাওয়ার শব্দ। আর সব চুপ। এমন সময় হঠাৎ কানে এল এক পরিচিত আওয়াজ–দুম দুম দুম দুম দুম্ দুম–আর তার সঙ্গে পায়ের। ধাক্কায় পাথর গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ। ক্রমে এদিকে আসছে শব্দটা। কাছে–আরও কাছে। এবার। সুড়ঙ্গের মুখের ঝোঁপঝাড় খচমচ করে উঠল। পরমুহূর্তেই আবছা অন্ধকারের ভিতর দিয়ে সৃষ্টিছাড়া নাম না জানা অতিকায় কী যেন একটা প্রায় নিঃশব্দ দ্রুতপদে গুহা থেকে বেরিয়ে আমার ঠিক পাশ দিয়ে গিয়ে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ভয়ে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। বুঝতে পারলাম, এতক্ষণ অপেক্ষা করা সত্ত্বেও, আমার মনটা এই অপ্রত্যাশিত ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
এবার আমার সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে জানোয়ারটার ফেরার অপেক্ষায় বসে রইলাম। গহ্বরের বাইরের শান্তিময় নিরুদ্বেগ পরিবেশ থেকে বোঝবার কোনও উপায় নেই যে, এক বিপুল বিঘুঁটে প্রাণী এই সবেমাত্র সেখানে হানা দিতে বেরিয়েছে। সেটা কতদূর যাবে, কী মতলবে গেছে, কখন ফিরবে, সেসব জানার কোনও উপায় নেই। পাথরের উপর বন্দুকের নলটাকে বসিয়ে মনে মনে। প্রতিজ্ঞা করলাম যে, দ্বিতীয়বার আর সংকট-মুহূর্তে সাহস হারাব না। যত বড় দুশমনই হোক না কেন, এবার তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।
সজাগ থাকা সত্ত্বেও জানোয়ারটা যে কখন ফিরে এল, সেটা টেরই পাইনি। হঠাৎ সামনে চেয়ে দেখি–আবার সেই অতিকায় জানোয়ার–ঘাসের উপর দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে ব্লু-জন সুড়ঙ্গের দিকে আসছে। আবার অনুভব করলাম বন্দুকের ঘোড়র উপর রাখা আমার ডান হাতের তর্জনীটা অবশ হয়ে আসছে। প্রাণপণ চেষ্টা করে কোনওরকমে আমার জড় ভাবটাকে কাটিয়ে উঠলাম। ঝোঁপঝাড় ভেদ করে জানোয়ারটা গুহার ভিতর ঢুকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে এসেছে, এমন সময় আমি বন্দুকের ঘোড়া টিপে দিলাম। বারুদের ঝলসানিতে মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলাম এক প্রকাণ্ড, লোমশ ছাই রঙের
জানোয়ার, নীচের দিকে রঙটা ফিকে হয়ে এসেছে–বেঁটে বেঁটে বাঁকানো পায়ের উপর তার আলিসান শরীরটাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এক ঝলকের দেখা–আর তারপরেই শুনলাম খড়বড় শব্দ। আগা পাথরের উপর দিয়ে নেমে জানোয়ারটা চলেছে তার গর্তের দিকে। আমার মাথায় হঠাৎ যেন খুন চাপল। ভয়ডর সব দূর করে দিয়ে এক লাফে পাথরের উপর থেকে নেমে বন্দুক ও লণ্ঠন হাতে সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে ছুটে চললাম জানোয়ারটার উদ্দেশে।
আমার লণ্ঠনের উজ্জ্বল রশ্মি সামনের অন্ধকার ভেদ করে চলেছে। এ সেই দু সপ্তাহ আগের টিমটিমে মোমবাতির আলো নয়। কিছুটা পথ দৌড়নোর পরই জানোয়ারটাকে দেখতে পেলাম–সুড়ঙ্গের এপাশ ওপাশ জুড়ে থপথপিয়ে এগিয়ে চলেছে, তার পায়ের লম্বা ও রুক্ষ নোম চলার সঙ্গে সঙ্গে দুলছে। লোম দেখে যদিও ভেড়ার কথা মনে হয়, আয়তনে জানোয়ারটা সবচেয়ে বড় হাতির চেয়েও বেশ খানিকটা বড়–আর যত লম্বা, ততই যেন চওড়া। পাহাড়ের সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে এই বিরাট বীভৎস জানোয়ারের পিছনে ধাওয়া করার সাহস আমি কোথা থেকে পেলাম জানি না। আদিম শিকারের নেশা যখন মানুষকে পেয়ে বসে, আর সেই শিকার যদি চোখের সামনে পালায়, তা হলে মানুষ যেন দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তার পিছনে ছোটে। দোনলা বন্দুক হাতে তাই আমি ছুটে চলেছি এই দানবের পিছনে।
জানোয়ারটা যে রীতিমতো দ্রুতগতি, সেটা আমি আগে লক্ষ করেছিলাম। এবারে বুঝলাম যে তার আর একটি মারাত্মক গুণ আছে, সেটা হল শয়তানি বুদ্ধি। হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল, সে বুঝি প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে। সে যে আবার উলটোমুখে ঘুরে রুখে দাঁড়াতে পারে, সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আগেই বলেছি, সুড়ঙ্গটা গিয়ে পড়েছে একটা বিরাট গহ্বরে। কিছুক্ষণ দৌড়নোর পর সেই গহুরটাতে পৌঁছতে হঠাৎ জানোয়ারটা থমকে থেমে আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল।
লণ্ঠনের সাদা আলোতে তার যা চেহারা দেখলাম, তা আমি জীবনে ভুলতে পারব না। ভাল্লুকের মতো হিংস্র ভঙ্গিতে সামনের দু পা শূন্যে তুলে দাঁড়িয়ে আছে পর্বতপ্রমাণ জানোয়ারটা, আয়তনে ভাল্লুকের দশগুণ, উঁচানো দুই পায়ের থাবায় লম্বা তীক্ষ্ণ বাঁকানো নখ, বীভৎস বিকৃত হাঁ করা লাল মুখে ধারালো দাঁতের সারি। ভাল্লুকের সঙ্গে পার্থক্য কেবল একটা ব্যাপারে–যে ব্যাপারে এটার সঙ্গে পৃথিবীর আর কোনও জানোয়ারের কোনও মিল নেই–সেটা হল জানোয়ারটার ঠিকরে বেরিয়ে আসা, দৃষ্টিহীন, মণিহীন, জ্বলন্ত বলের মতো দুটো চোখ। কী দেখলাম সেটা ভাল করে বোঝার আগেই জানোয়ারটা থাবা উচিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এর পরে আমার হাত থেকে লণ্ঠনটা ছিটকে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কিছু মনে নেই।