এপ্রিল ২৭
ছাত্রাবস্থায় সাহস ও উদ্যমের জন্য আমার বেশ খ্যাতি ছিল। একবার কোল্টব্রিজের এক হানাবাড়িতে রাত কাটাবার কথা উঠলে আমিই প্রথম এগিয়ে গিয়েছিলাম। এখন আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। তা হলে কি বয়স বাড়ার ফলেই আমার সাহস কমেছে, না কি আমার রোগই এর কারণ? গহুর আর তার অধিবাসীর কথা ভাবলে এখনও আমার মনে আতঙ্ক উপস্থিত হয়। এ অবস্থায় কী করা যায়, এ প্রশ্ন প্রতি মুহূর্তেই আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। কাউকে কিছু না বলে যদি চুপচাপ বসে থাকি, তা হলে হয়তো গহ্বরের রহস্য চিরকাল রহস্যই থেকে যাবে। আবার যদি সকলের কাছে সব কিছু প্রকাশ করে ফেলি, তা হলে হয়তো সারা গ্রাম জুড়ে একেবারে আতঙ্কের বন্যা বয়ে যাবে। আর না হয় তো এরা আমাকে পাগল ভেবে সেই গারদেই চালান দেবে। সবচেয়ে ভাল পন্থা বোধহয়। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করে আরও ভালভাবে আঁটঘাট বেঁধে আর একবার গহ্বরে অভিযান। আমি এর মধ্যেই কালটনে গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে এনেছি। তার মধ্যে প্রধান হল একটা অ্যাসিটিলিন ল্যাম্প ও একটা দোনলা বন্দুক। দ্বিতীয়টা অবশ্য ধার করতে হয়েছে, কিন্তু এক ডজন ভাল কার্তুজ আমি নিজে পয়সা খরচ করে কিনেছি। যা আছে, তাতে একটা আস্ত গণ্ডার অনায়াসে ধরাশায়ী করা চলে। মোট কথা, আমার গুহাবাসী বন্ধুটির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আমি। প্রস্তুত। কিছুটা স্বাস্থ্যোন্নতি ও আরও খানিকটা মনের জোর পেলেই আমি যুদ্ধং দেহি বলে বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু আপাতত, এই জানোয়ারটি ঠিক কোন জাতের সে প্রশ্নে আমার ঘুম নষ্ট হতে চলেছে। একের পর এক নানান জবাব আমি নিজেই বাতিল করে দিয়েছি। ভেবে ভেবে কোনও কূল-কিনারা পাচ্ছি না। এটা যে একটা রক্তমাংসের জ্যান্ত জানোয়ার, সেটা তো তার চিৎকার আর তার পায়ের ছাপ থেকেই প্রমাণ হয়। তা হলে কি হিংস্র ড্রাগন জাতীয় যেসব প্রাণীর কথা আমরা রূপকথায় পড়েছি, সেগুলো আসলে কাল্পনিক নয়? তাদের খানিকটা অংশ কি আসলে সত্যি, এবং সেই সত্যটুকু প্রমাণ করার ভার কি শেষটায় আমার উপর পড়ল?
৩ মে
কদিন যাবৎ এখানকার বসন্তকালের খামখেয়ালি আবহাওয়াটা আমাকে বেশ কাবু করেছে। আর এই কদিনের ভিতরই এমন কিছু উদ্ভট ঘটনা ঘটেছে, যার তাৎপর্য কেবল আমিই বুঝি। রাতগুলো মেঘলা হওয়ায় তিনদিন চাঁদের আলো ছিল না। এর আগে ঠিক এমন রাত্রেই একটি ভেড়া উধাও হয়েছে। গত কয়েক রাত্রেও ভেড়া লোপ পেয়েছে–অ্যালারটনদের দুটি, ক্যাটওয়াকের বুড়ো পিয়ার্সনের একটি ও মিসেস মুলটনের একটি। তিন রাত্রে চারটি ভেড়া উধাও। কোনও চিহ্নই পাওয়া যায়নি সেগুলোর, ফলে চতুর্দিকে নানারকম গুজব রটছে। কেউ বলে এটা ভেড়া-চোরের কাজ, কেউ বলে আশেপাশে নাকি বেদেরা আস্তানা গেড়েছে–এ হল তাদেরই কীর্তি।
কিন্তু এর চেয়েও গুরুতর একটা ঘটনা ঘটেছে গত কদিনের মধ্যে; আর্মিটেজ নিখোঁজ। গত বুধবার রাত্রে সে নাকি তার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল; তারপর থেকে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর্মিটেজের আত্মীয়স্বজন নেই, তাই তার অন্তর্ধান তেমন একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেনি। লোকে বলছে সে নাকি অনেক টাকা ধারত, তাই অন্য কোনও জায়গায় চাকরি নিয়ে চলে গেছে–সেখান থেকে কদিনের মধ্যেই হয়তো তার জিনিসপত্র চেয়ে পাঠাবে। আমার নিজের কিন্তু অন্যরকম আশঙ্কা হচ্ছে। আমার বিশ্বাস ভেড়া-চুরির ব্যাপারটার কোনও একটা বিহিত করতে গিয়েই সে প্রাণ হারিয়েছে। হয়তো সে ওই অজ্ঞাত জীবটির অপেক্ষায় ওত পেতে বসে ছিল, আর সেটা উলটে তাকেই আক্রমণ করে তার গহ্বরের ডেরায় নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। বিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের মতো সভ্য দেশে এ ধরনের ঘটনা ভাবতেও অবাক লাগে, যদিও আমার মতে এটা মোটেই অসম্ভব নয়। আর সত্যিই যদি তাই হয়, তা হলে কি আমার এ ব্যাপারে একটা দায়িত্ব নেই? আমি যখন এতদূরই জেনেছি, তখন আমার কর্তব্য এটার একটা প্রতিকারের চেষ্টা করা–সম্ভব হলে নিজেই। আজকের একটা ঘটনার পর আমি স্থির করেছি, নিজেই এব্যাপারে একটা কিছু করব। সকালে স্থানীয় পুলিশ-স্টেশনে গিয়েছিলাম। ইনস্পেক্টর সাহেব গম্ভীর ভাবে আমার বক্তব্য একটা মোটা খাতায় তুলে নিয়ে আমাকে নমস্কার করে বিদায় দিলেন। বাইরে বেরোতে না বেরোতে শুনতে পেলাম তাঁর অট্টহাসি। বুঝতে পারলাম, তিনি তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের কাছে আমার কাহিনীটা বেশ রসিয়ে পুনরাবৃত্তি করছেন।
ঠিক দেড় মাস পর আমার খাটে বালিশের ওপর পিঠ দিয়ে বসে আমি আবার ডায়রি লিখছি। শরীর ও মন বিপর্যস্ত বিহুল হয়ে আছে। যে সংকটের সামনে পড়তে হয়েছিল, আর কোনও মানুষের ভাগ্যে তেমন হয়েছে কিনা জানি না। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। ব্লু-জন গ্যাপের বিভীষিকা চিরকালের মতো বিদায় হয়েছে, জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য আমার মতো রুগণ ব্যক্তির পক্ষেও কিছু করা সম্ভব হয়েছে। এইবারে যথাসম্ভব পরিষ্কার ভাবে যা ঘটেছিল, তার বিবরণ দিই।
.
৩ মের রাতটা ছিল অন্ধকার ও মেঘাচ্ছন্ন–ঠিক যেমন রাত্রে নাম-না-জানা জানোয়ারটা হানা দিতে বেরোয়। রাত এগারোটায় হাতে লণ্ঠন ও বন্দুক নিয়ে আমি বাড়ি থেকে রওয়ানা দিলাম। যাওয়ার আগে টেবিলের উপর একটা কাগজে লিখে গেলাম যে, আমি যদি না ফিরি, তা হলে যেন ব্লু-জন গ্যাপের আশেপাশে আমার অনুসন্ধান করা হয়। রোমান সুড়ঙ্গের মুখটাতে পোঁছে, কাছাকাছি একটা পাথরের ঢিপি বেছে নিয়ে লণ্ঠনের ঢাকনাটা বন্ধ করে হাতে বন্দুক নিয়ে ঢিপিটার উপর ঘাপটি মেরে বসে রইলাম।