পায়ের আওয়াজ শুনতে শুনতে আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে এল। কোনও অজ্ঞাত প্রাণী অন্ধকারের বাধা অগ্রাহ্য করে এগিয়ে আসছে। আমি পাথরের উপর সটান শুয়ে পড়ে নিজেকে যথাসম্ভব অদৃশ্য করে ফেলার চেষ্টা করলাম। শব্দটা এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ থেমে গেল। তারপর শুরু হল একটা সপাৎ সপাৎ আওয়াজ। জন্তুটা নালার জল খাচ্ছে। তারপর একটুক্ষণ চুপচাপ, কেবল মধ্যে মধ্যে প্রচণ্ড নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ, আর নাক টেনে গন্ধ শোঁকার শব্দ। জন্তুটা কি আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে গেল নাকি? আমার নিজের নাক তখন একটা বিশ্রী বুনো গন্ধে ভরে আছে। তারপর আবার শুরু হল পায়ের শব্দ, আর সেটা যেন নালার এদিকে আমার কাছেই। আমার হাতকয়েকের মধ্যে কিছু আলগা পাথর খড়বড় করে উঠল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে পাথরের উপর ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। তারপর শুনলাম পায়ের শব্দ পিছিয়ে যাচ্ছে। জলের ছপছপানি শুনে বুঝলাম, জন্তুটা নালা পেরিয়ে উলটো দিকে চলে যাচ্ছে। ক্রমে যেদিক দিয়ে শব্দটা এসেছিল সেইদিকেই আবার সেটা মিলিয়ে গেল।
আমি বেশ কিছুক্ষণ পাথরের উপর পড়ে রইলাম। ভয়ে নড়বার শক্তি ছিল না। শব্দটার কথা বারবার মনে পড়তে লাগল, আর আর্মিটেজের আতঙ্কের কথা, আর নরম কাদার উপর সেই বিরাট পায়ের ছাপের কথা।
এখন আর কোনও সন্দেহ নেই যে, পাহাড়ের এই গহ্বরে কোনও এক নাম-না-জানা, ভয়াবহ, অতিকায় প্রাণী বাস করছে। সেটা যে কেমন দেখতে, তা এখনও অনুমান করতে পারিনি, তবে এটুকু জানি যে, সেটা আয়তনে বিরাট এবং আশ্চর্য দ্রুতগতি। সাধারণ বুদ্ধিতে বলে, এমন জানোয়ার অসম্ভব, কিন্তু আমার আজকের অভিজ্ঞতা এর বিপরীত সাক্ষ্য দিচ্ছে। এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব আমার মনকে অস্থির করে তুলল। অবশেষে মনকে বোঝালাম যে, আমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছি। আমার রুগণ অবস্থাই আমার মনে এক কাল্পনিক বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু, এবার যে ঘটনাটা ঘটল, তাতে আমার মনে আর সন্দেহের কোনও কারণই রইল না।
আমার দেশলাই এতক্ষণে শুকিয়েছে মনে করে আমি বগল থেকে সেটা বার করে একটা কাঠি নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। গহ্বরের ফাটলে হাত ঢুকিয়ে বাক্সের গায়ে কাঠি ঘষতেই সেটা ফস্ করে জ্বলে ইঠল। মোমবাতি জ্বালিয়ে, যেদিকে জানোয়ার গেছে সেদিকে একবার ভয়ে ভয়ে দেখে নিয়ে রোমান সুড়ঙ্গের দিকে রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে জমির নরম অংশটাতে চোখ পড়তেই দেখলাম, আগের ছাপের মতো আরও তিনটে টাটকা ছাপ সেখানে পড়েছে, সেইরকমই গভীর আর সেইরকমই বিরাট। এ-দৃশ্যে আবার নতুন করে যেন ভয়ে আমার হৃৎকম্প শুরু হল। আমি মোমবাতির শিখাটাকে হাত দিয়ে আড়াল করে প্রাণপণে সুড়ঙ্গপথ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে, এক নিশ্বাসে দরজার মুখ দিয়ে বেরিয়ে কাঁটাঝোঁপ ভেদ করে হাঁপাতে হাঁপাতে বাইরের ঘাসের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। মাথার উপর আকাশে তখন অজস্র তারা ঝলমল করছে।
বাড়ি পৌঁছলাম রাত তিনটায়। আজ এখন পর্যন্ত আমার স্নায়ুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে আতঙ্ক ও উত্তেজনার শিহরন রয়েছে। কিন্তু এখনও আমি কাউকে কিছু বলিনি। এব্যাপারে খুব সাবধানে এগোতে হবে। এখানকার সরল গ্রাম্য অধিবাসীরা, বা নিরীহ অ্যালারটন ভগিনীদ্বয়, আমার এ ঘটনা শুনলে কী মনে করবে জানি না। আমার এখন এমন কারুর কাছে যাওয়া উচিত, যাকে ঘটনাটা বললে সে একটা উপায় বাতলাতে পারবে।
এপ্রিল ২৫
গহ্বরের অভিজ্ঞতার পর দুদিন আমি শয্যাশায়ী ছিলাম। গত ক দিনের মধ্যে আমার এমন আর একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে, যাতে অন্যটার চেয়ে কিছু কম ধাক্কা খাইনি। আগেই বলেছি, আমি এমন। একজনের অনুসন্ধান করছিলাম, যে আমাকে কিছুটা পরামর্শ দিতে পারবে। এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে মার্ক জনসন বলে এক ডাক্তার থাকেন। প্রফেসর স্যান্ডারসন এই ডাক্তারটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে একটা চিঠি আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। আমি একটু সুস্থ হয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে ঘটনাটা খুলে বললাম। তিনি মনোযোগ সহকারে সবকিছু শোনার পর আমার স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া ও আমার চোখের মণি খুব ভাল করে পরীক্ষা করে দেখলেন। দেখা শেষ হলে পর তিনি কোনও আলোচনার দিকে না গিয়ে সোজাসুজি বললেন যে, আমার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ তাঁর আওতার। বাইরে। তবে কাসলটনে মিঃ পিটন বলে এক ভদ্রলোক থাকেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করে আমার ঘটনাটা তাঁকে আদ্যোপান্ত জানানো দরকার। তিনিই নাকি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন।
অগত্যা, স্টেশন থেকে দশ মাইল দূরে একটা ছোট্ট শহরে গিয়ে হাজির হতে হল। শহরের এক প্রান্তে একটা সম্রান্ত অট্টালিকার সামনে গেটের গায়ে পিতলের ফলকে পিল্টনের নাম দেখে বুঝলাম তিনি এখানকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। দরজায় বেল-টা টেপার সময় মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগল। কাছাকাছি একটা দোকানে গিয়ে মালিককে পিটন সাহেব সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করায়। তিনি একগাল হেসে বললেন, সে কী, জানেন না? উনি যে এ-তল্লাটে সবচেয়ে নামকরা মাথার ব্যানোর ডাক্তার! ওই তো ওর পাগলা গারদ। বলা বাহুল্য, আমি আর এক মুহূর্তও সেখানে
থেকে সোজা আমার গ্রামে ফিরে এলাম। চুলোয় যাক এইসব পণ্ডিত লোক। এঁরা যেন এঁদের জ্ঞানের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে কোনও কিছুই স্বীকার করতে চান না। অবশ্য, এখন ঠাণ্ডা মাথায় বুঝতে পারছি যে, আমি আর্মিটেজের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি, জনসনও আমার সঙ্গে ঠিক সেই একই ব্যবহার করেছেন।