অবশেষে নিজের মনকে বোঝালাম যে, অতবড় ছাপ যখন কোনও পরিচিত জানোয়ারের হতে পারে না–এমনকী হাতিরও নয়, তখন এ ধরনের অমূলক কল্পনাকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে আমার কাজের ব্যাঘাত ঘটানো ছাড়া আর কিছুই নয়। আরও এগোনোর আগে আমি একবার যে সুড়ঙ্গটা দিয়ে গহ্বরে এসে পৌঁছেছি, তার মুখের চেহারাটা ভাল করে দেখে চিনে রাখলাম। এ কাজটা খুবই দরকারি, কারণ এটা ছাড়া আরও অনেকগুলো রাস্তা গহ্বর থেকে বেরিয়েছে। কোথায় ফিরতে হবে সেটা জেনে নিয়ে, অবশিষ্ট মোমবাতি ও দেশলাই-এর কাঠিগুলো একবার পরীক্ষা করে, আমি অসমতল পাথরের উপর দিয়ে গহ্বরের ভিতর এগিয়ে চললাম।
রওনা হওয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আচমকা এক চরম বিপদের সামনে পড়তে হল। আমার সামনে দিয়েই বয়ে চলেছিল প্রায় বিশ ফুট চওড়া একটা নালা। সেটাতে পা না ভিজিয়ে টপকে পার হওয়া যায় কোনখান দিয়ে, সেটা দেখবার জন্য আমি জলের ধার দিয়ে হেঁটে চলেছি, এমন সময় নালার উপর একটা পাথরের ঢিপি চোখে পড়ল। আন্দাজে মনে হল এক লাফে সেই টিপিটার উপর পৌঁছনো যায়। কিন্তু পাথরের তলার দিকটা জলে ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে সেটার উপর লাফ দিয়ে। পড়তেই পাথরটা কাত হয়ে আমায় ফেলে দিল একেবারে বরফের মতো ঠাণ্ডা নালার জলে। মোমবাতিটা নিভে গেল সঙ্গে সঙ্গেই, আর আমি ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে জলের মধ্যে পড়ে অসহায়ভাবে এদিক ওদিক হাতড়াতে লাগলাম।
শেষটায় কোনওরকমে দাঁড়িয়ে উঠে নিজের গোঁয়ার্তুমির কথা ভেবে ভয়ের চেয়ে হাসিই পেল বেশি। জ্বলন্ত মোমবাতিটা অবশ্যই জলে পড়ে খোয়া গেছে, কিন্তু আমার পকেটে রয়েছে আরও। দুটো, কাজেই চিন্তা নেই। একটা মোমবাতি বার করে সেটা জ্বালাতে গিয়ে বুঝতে পারলাম বিপদটা কোথায়; জলে পড়ার ফলে আমার দেশলাইয়ের বাক্সটা ভিজে একেবারে সপে হয়ে গিয়েছে, ফলে সেটাতে আর কোনও কাজই হবে না।
এবার সত্যি করেই আমার রক্ত হিম হয়ে এল। অন্ধকারের নমুনাটাও এবার বেশ বুঝতে পারলাম। চারদিক থেকে সে অন্ধকার যেন আমায় ঘিরে চেপে ধরেছে; হাত দিয়ে যেন সে অন্ধকারের ঘনত্ব অনুভব করা যায়। আমি কোনওরকমে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম। গহ্বরের কোনদিকে কী আছে সেটা প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে চেষ্টাও বৃথা কারণ চিনে রাখার মতো যা কিছু দেখে রেখেছিলাম, তা সবই দেওয়ালের উপর দিকে–সুতরাং মেঝে হাতড়ে কোনও ফলই হবে না। তাও, হয়তো দেওয়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে সাবধানে এগোলে আবার রোমান সুড়ঙ্গর মুখটায় পৌঁছনো যেতে পারে, এই মনে করে আমি এক পা দু পা করে দেওয়ালের দিক আন্দাজ করে এগোতে লাগলাম। অচিরেই বুঝতে পারলাম, এ চেষ্টায় কোনও ফল হবে না। ওই বেয়াড়া অন্ধকারে দশ বারো পা হাঁটার পরেই বুঝলাম যে, এ অবস্থায় দিক্বিদিজ্ঞান বজায় রাখা অসম্ভব। নালার কুলকুল শব্দ থেকে অবশ্য বুঝতে পারছিলাম সেটা কোনখান দিয়ে বইছে–কিন্তু সেটা থেকে সামান্য দূরে গেলেই নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় মনে হচ্ছিল। বুঝলাম এ অবস্থায় গহ্বর থেকে বেরোনোর কোনও উপায় নেই।
আমি আবার সেই পাথরটার উপর বসে আমার শোচনীয় অবস্থা সম্বন্ধে ভাবতে আরম্ভ করলাম। আমি যে ব্লু-জন গহুরে অভিযানের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলাম, সে কথা আমি কাউকে বলিনি। সুতরাং আমি হারিয়ে গেলেও আমাকে খুঁজতে কোনও সার্চ-পার্টি যে এদিকে আসবে এমন কোনও আশা নেই। একমাত্র নিজের উপস্থিত বুদ্ধি ছাড়া আমার আর কোনও অবলম্বন নেই। মুক্তির উপায় যেটা রয়েছে, সেটা হল কোনও একটা পন্থা বার করে দেশলাইগুলোকে শুকিয়ে নেওয়া। আমি যখন জলে পড়েছিলাম, তখন আমার শরীরের একটা দিকই ভিজেছিল। বাঁ দিকের কাঁধটা জলের উপরে ছিল। আমি দেশলাইয়ের বাক্সটা বার করে সেটাকে আমার বাঁ বগলের তলায় চেপে বসে রইলাম। শরীরের উত্তাপ সেটাকে শুকোনোর কাজে নিশ্চয়ই কিছুটা সাহায্য করবে। তবে কমপক্ষে ঘণ্টাখানেকের আগে মোমবাতি জ্বালানোর কোনও সম্ভাবনা নেই এবং এই ঘন্টাখানেক চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কোনও গতি নেই।
আসবার সময় কিছু বিস্কুট পকেটে পুরে এনেছিলাম, তারই একটা মুখে পুরে চিবোতে লাগলাম। বিস্কুটের শুকনো ভাবটা কাটানোর জন্য যে নালায় আমার পতন হয়েছিল, তারই খানিকটা জল আঁজলা করে তুলে মুখে ঢেলে দিলাম।
খাওয়া শেষ হলে পর নিজের শরীরটাকে ঢিপির উপর একটু এদিক-ওদিক নেড়ে ঠেস দেওয়ার একটা জায়গা বার করে, পা ছড়িয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। গহ্বরের স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডাটা বেশ তীব্রভাবেই অনুভব করছিলাম, কিন্তু মনকে বোঝালাম যে, আধুনিক চিকিৎসকদের মতে আমার যে রোগ, তাতে জানলা খুলে শোয়া, এবং শীত-গ্রীষ্ম নির্বিশেষে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচরণ–এ দুটোর কোনওটাই নিষিদ্ধ নয়। ক্রমে গহ্বরের দুর্ভেদ্য অন্ধকার ও নালার একঘেঁয়ে কুলকুলুনি আমায় তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলল।
কতক্ষণ এইভাবে ছিলাম জানি না। ঘণ্টাখানেক কিংবা তারও হয়তো কিছু বেশি হবে। এমন সময় হঠাৎ আমাকে সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে ঢিপির উপর সোজা হয়ে উঠে বসতে হল। আমার কানে একটা শব্দ এসেছে, যেটা নালার শব্দের চেয়ে একেবারে আলাদা। শব্দটা এখন আর নেই, কিন্তু তার প্রতিধ্বনি এখনও আমার কানে বাজছে। এটা কি মানুষের পায়ের শব্দ? আমাকে খুঁজতে এসেছে। কি কোনও দল? কিন্তু তাই যদি হয় তা হলে তো তারা আমার নাম ধরে ডাকবে। যা শুনেছি তা তো মানুষের গলার শব্দ নয়! আমি দুরু দুরু বক্ষে দম প্রায় বন্ধ করে বসে রইলাম। ওই যে–আবার সেই শব্দ! ওই–আবার! এবার আর থামা নেই। একটানা শব্দ আসছে–কোনও জানোয়ারের পদক্ষেপের শব্দ–দুম দুম দুম দুম্! কী বিশাল এই পদধ্বনি! জানোয়ারটি যে আয়তনে বিরাট, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু মনে হয় পায়ের তেলোগুলো নরম হওয়ার ফলে শব্দটা খানিকটা চাপা। এই অন্ধকারেও সেই পদক্ষেপে বিন্দুমাত্র ইতস্তত ভাব নেই। আর এতেও কোনও সন্দেহ নেই যে, সেটা আমার দিকেই আসছে।