আর তার পরমুহূর্তে ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। আমি গহ্বরের মুখটায় দাঁড়িয়ে, আর্মিটেজের কথাগুলো কত সহজে হেসে উড়িয়ে দেওয়া গেল তাই ভাবছি, এমন সময় সত্যিই গহ্বরের ভিতর থেকে এল এক অদ্ভুত শব্দ। সেশব্দের সঠিক বর্ণনা দেব কী করে? প্রথমত, শুনে মনে হল সেটা আসছে বহুদূর থেকে–যেন পৃথিবীর একেবারে গভীরে অবস্থিত কোনও জায়গা থেকে। কিন্তু দূর থেকে এলেও শব্দটা রীতিমতো জোরে। জলধারা বা পাথর গড়িয়ে পড়া থেকে যে শব্দ হয়, এটা সে জাতের নয়। এ-যেন এক তীব্র, তীক্ষ্ণ হ্রেষাধ্বনির মতো। এই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার ফলে কিছুক্ষণের জন্য আর্মিটেজের কথাগুলো আমাকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলল। আমি আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক গহ্বরের মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম, কিন্তু দ্বিতীয়বার আর সে-শব্দ শোনা গেল না। বাড়ি ফিরলাম মনে গভীর বিস্ময়ের ভাব নিয়ে। আর্মিটেজের কথায় আমল দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু এটা অস্বীকার করা চলে না যে, যে-শব্দটা আমি নিজের কানে শুনেছি, সেটা ভারী অদ্ভুত। এখনও লিখতে লিখতে যেন কানে সেশব্দটা শুনতে পাচ্ছি।
এপ্রিল ২০
গত তিন দিনে আমি বার কয়েক ব্লু-জন গ্যাপের দিকে গিয়েছি। এমনকী, সুড়ঙ্গের ভিতরেও কিছুদূর অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু আমার ল্যাম্পের আলো যথেষ্ট জোরালো না হওয়ায় বেশিদূর যেতে সাহস পাইনি। এবারে আরও আঁটঘাট বেঁধে যেতে হবে। শব্দটা আর দ্বিতীয়বার শোনার সৌভাগ্য হয়নি। এক-একবার মনে হয়েছে যে, প্রথমবারে শোনাটা হয়তো আমার আর্মিটেজের সঙ্গে কথাবার্তার ফলে আমার কল্পনাপ্রসূত। সমস্ত ব্যাপারটাই যে আজগুবি সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যদিও এটা না বলে পারছি না যে, গ্যাপের মুখে ঝোঁপঝাড়ের অবস্থা দেখে এক-এক সময় মনে হয়েছে যে, কোনও অতিকায় জীব হয়তো তার মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে যাতায়াত করছে। মোট কথা, আমার মনে একটা তীব্র কৌতূহল জেগে উঠেছে। অ্যালারটনদের আমি এখনও কিছু বলিনি, কারণ এঁরাও কুসংস্কার থেকে মুক্ত নন। কিন্তু আমি নিজে আরও অনুসন্ধান করব, আর তার। জন্য কিছু মোমবাতিও কিনে রেখেছি।
আজ সকালে গ্যাপের কাছাকাছি ঝোঁপের আশেপাশে কিছু ভেড়ার লোম পড়ে থাকতে দেখলাম। একটা লোমের গোছায় দেখি রক্ত লেগে রয়েছে। বেশ বুঝতে পারি যে, পাথুরে জায়গায় চরে বেড়ালে ভেড়াগুলো আপনা থেকেই জখম হতে পারে, কিন্তু তাও হঠাৎ ওই লালের ছোপ চোখে পড়াতে কেমন যেন চমকে উঠলাম। রোমানদের কারুকার্যে শোভিত গহ্বরের ওই প্রবেশদ্বার মনের মধ্যে একটা অজানা আতঙ্কের সঞ্চার করল। গহ্বরের অন্ধকারের ভিতর থেকে যেন আদ্যিকালের একটা ভ্যাপসা গন্ধ আসছে। সত্যিই কি কোনও নাম-না-জানা প্রাণী ওই অন্ধকারের মধ্যে বাস করে? সুস্থ অবস্থায় হয়তো এসব চিন্তা মাথায় আসত না। অসুখে মানুষের স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, আর তাই তার মনে নানান অসম্ভব কল্পনা দানা বাঁধতে পারে।
এইসব ভীতিজনক চিন্তা আমার সঙ্কল্পকে শিথিল করে দিয়েছিল। ভেবেছিলাম, গহ্বরের রহস্য রহস্যই থাক, এ নিয়ে আর মাথা ঘামাব না। কিন্তু আজ রাত্রে আবার নতুন করে উৎসাহ জেগে উঠেছে, আর মনেও অনেকটা জোর পাচ্ছি। আশা করি, কাল এব্যাপারে আরও কিছুদুর অগ্রসর হতে পারব।
এপ্রিল ২২
আমি যথাসাধ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে কালকের অদ্ভুত অভিজ্ঞতাটা বর্ণনা করার চেষ্টা করছি। কাল যখন আমি ব্লু-জন গ্যাপের উদ্দেশে রওনা দিই, তখন বিকেল। বলতে দ্বিধা নেই, সেখানে পৌঁছে। গহ্বরের দুর্ভেদ্য অন্ধকারের দিকে চাইতেই আবার যেন সেই আশঙ্কার ভাবটা আমার মনে জেগে উঠল। মনে হল, একা না এসে একজন সঙ্গী আনা বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ হত। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত মনে সাহস ফিরিয়ে এনে মোমবাতি জ্বেলে কাঁটা-ঝোঁপের জঙ্গল ভেদ করে গহ্বরের ভিতর ঢুকলাম।
আলগা পাথরের ঢাকা জমির উপর দিয়ে প্রায় পঞ্চাশ ফুট নামার পর একটা রাস্তা পেলাম, যেটা একেবারে পাহাড় ভেদ করে সোজা সামনের দিকে চলে গেছে। যদিও আমি জিওলজিস্ট নই, তবু এটুকু বুঝতে পারলাম যে, এ পাথর লাইমস্টোনের চেয়ে অনেক বেশি শক্ত জাতের কোনও পাথর, কারণ এর গায়ে প্রাচীন শাবলের দাগ রয়েছে। দেখলে মনে হয় যেন এই সবেমাত্র খোঁড়া হয়েছে। আমি কোনওমতে হোঁচট খেতে খেতে এই প্রাচীন পাথরের সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললাম। আমার হাতের মোমবাতি আমাকে ঘিরে একটা ক্ষুদ্র আলোর গণ্ডি রচনা করেছে। তার ফলে সামনের সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় পৌঁছে দেখি সেটা গিয়ে পড়েছে একটা বিশাল নোনা-ধরা পাথরের গহ্বরে, যার ছাত থেকে ঝুলে আছে চুনে-ঢাকা অসংখ্য লম্বা-লম্বা আইসি। আবছা আলোয় আরও লক্ষ করলাম যে, গহ্বরের দেওয়াল ভেদ করে চারদিক দিয়ে আরও অনেকগুলো জলে-ক্ষয়ে-যাওয়া রাস্তা এঁকেবেঁকে কোথায় যেন গিয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরও এগোব না ফিরে যাব তাই ভাবছি, এমন সময় আমার পায়ের কাছে একটা জিনিস প্রবলভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
গহ্বরের মেঝেয় অধিকাংশটাই হয় পাথর না হয় চুনের আবরণে ঢাকা; কিন্তু একটা জায়গায় বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে ছাত থেকে জল ছুঁইয়ে পড়ে কাদা হয়ে আছে। সেই কাদার ঠিক মাঝখানে দেখলাম একটা প্রকাণ্ড ছাপ, অস্পষ্ট অথচ গভীর। উপর থেকে পাথরের চাঁই পড়লে যেরকম হয় অনেকটা সেইরকম। কিন্তু কাছাকাছির মধ্যে কোনও আগা পাথর বা এমন কিছু লক্ষ করলাম না, যাকে ওই ছাপের জন্য দায়ী করা চলে। অথচ কোনও পরিচিত জন্তুর এতবড় পায়ের ছাপ পড়া সম্ভব নয়। আর জন্তুই যদি হয়, তা হলে মাত্র একটা পায়ের ছাপ কেন? যতখানি জায়গা জুড়ে কাদা হয়েছে, কোনও চেনা জন্তু অন্তত আর-একটা ছাপ না ফেলে অতখানি জায়গা পেরোতে পারে না। যাই হোক, আমি ওই আশ্চর্য ছাপটা পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়িয়ে, চারদিকে অন্ধকারের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলাম আমার বুকের ভিতরে একটা দুরু দুরু কাঁপুনি শুরু হয়েছে, আর তার সঙ্গে আমার হাতের মোমবাতিটাও কিছুতে স্থির রাখতে পারছি না।