আমার অসুখের সময়ের একটা ঘটনা আমার মনে আছে। অত্যন্ত স্পষ্ট হওয়াতে এই স্মৃতিটাকে আমার স্বরবিকারজনিত দুঃস্বপ্নের অঙ্গ বলে মনে হয় না। এক রাত্রেনার্স তখন আমার ঘরে নেই–দরজা খুলে প্রবেশ করলেন এক দীঘাঙ্গিনী, তাঁর পরনে বিধবার কালো পোশাক। তিনি কাছে এসে আমার উপর ঝুঁকে পড়াতে দেখলাম এভারার্ড যে ব্রেজিলীয় মহিলাটি বিবাহ করেছিল, ইনি তিনিই। তাঁর চাহনিতে যে করুণা ও সহানুভূতি দেখলাম, তেমন আর কোনওদিন দেখিনি।
আপনার জ্ঞান আছে? জিজ্ঞেস করলেন মহিলা।
আমি তখন খুবই দুর্বল, তাই মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালাম।
আমি এইটুকু বলতে এসেছি যে, আপনার এই দুর্দশার জন্য আপনিই দায়ী। আমি তো চেষ্টার কোনও ত্রুটি করনি। প্রথম থেকেই চেয়েছিলাম যাতে আপনি না থাকেন। আপনি যাতে তাঁর কবলে না পড়েন তার জন্য আমার স্বামীকে বঞ্চনা করে যতটা করা সম্ভব সবই করেছিলাম আমি।
আমি জানতাম সে আপনাকে কেন ডেকে এনেছিল। আমি জানতাম সে আর কোনওদিন আপনাকে ফিরে যেতে দেবে না। আমি যত ভাল করে চিনতাম তাকে, তেমন তো আর কেউ চিনত না! আমি নিজে যে ভূক্তভোগী! সে কথা তো আর আপনাকে বলা যায় না। কিন্তু আপনার যাতে মঙ্গল হয় তার চেষ্টার ত্রুটি করিনি আমি। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, আপনি আমার বন্ধুর কাজ করেছেন। আমি ভাবতাম আমার মৃত্যু না হলে আমার মুক্তি নেই, কিন্তু আপনি আমার মুক্তি দিয়েছেন তাঁর কবল থেকে। আপনার এত কষ্টভোগ করতে হল বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু আমি তো বলেইছিলাম–আপনি মূর্খ, এবং মূর্খের মতোই কাজ করেছিলেন আপনি।
কথাটা বলে চলে গেলেন সেই আশ্চর্য মহিলা, যাঁকে আর কোনওদিন দেখিনি আমি। স্বামীর সম্পত্তি থেকে তাঁর যা প্রাপ্য তাই নিয়ে তিনি দেশে ফিরে গিয়েছিলেন, এবং পরে নাকি সন্ন্যাসিনী হয়ে গিয়েছিলেন।
লন্ডনে ফেরার বেশ কিছুদিন পরে ডাক্তার আমাকে জানালেন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ, এবং আবার কাজ শুরু করতে পারি। কথাটা শুনে আমার মনটা যে খুব প্রসন্ন হল তা নয়, কারণ কাজ মানেই পাওনাদারের স্রোত রোধ করার চেষ্টা। আসল খবরটা প্রথম দিল আমার উকিল সামান্স।
আপনি আবার সুস্থ হয়ে উঠেছেন এটা খুবই আনন্দের কথা, বলল সামারস। আপনাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমি।
অভিনন্দন? তুমি কী বলছ সামারস! মশকরা করার সময় নয় এটা।
যা বলছি ঠিকই বলছি, বলল সামারস। গত দেড় মাস হল আপনি লর্ড সাদারটন হয়েছেন। পাছে অসুস্থ অবস্থায় খবরটা পেলে আপনার রোগমুক্তিতে ব্যাঘাত ঘটে, তাই এতদিন বলিনি।
লর্ড সাদারটন! ইংল্যান্ডের অন্যতম সবচেয়ে বিত্তবান অভিজাত বংশের প্রতিভূ। আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তারপর মনে পড়ল যে, অনেকটা সময় তো পেরিয়ে গেছে এর মধ্যে, আর আমি তো এই সময়টা ছিলাম শয্যাশায়ী। বললাম, তাহলে লর্ড সাদারটন মারা গেছেন আমি অসুস্থ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই?
ঠিক সেই একই দিনে, আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলল সামারস। সে বুদ্ধিমান লোক, সে কি আর অনুমান করতে পারেনি আমার দুর্দশার কারণটা? কিন্তু আমি তাকে কিছু বললাম না। তার কাছে আগ বাড়িয়ে পারিবারিক কুৎসা রটাতে যাব কেন?
হুঁ, ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্য, আমার দিকে সেই একই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সে বলল। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, আপনার অবর্তমানে এই এভারার্ড কিংই পেতেন ওই খেতাব। তিনি না হয়ে আপনি যদি ওই বাঘের কবলে পড়তেন তা হলে উনিই হতেন লর্ড সাদারটন।
তা তো বটেই, বললাম আমি।
আর ভদ্রলোক এ ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন, বলল সামার। আমি জানি লর্ড সাদারটনের চাকরের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ ছিল, আর সেই চাকর ঘন ঘন টেলিগ্রাম করে কিংকে জানাত তার মনিবের অবস্থা। সেই সময়টা আপনি কিং-এর বাড়িতে। আপনি উত্তরাধিকারী, অথচ বারবার সে খোঁজ নিচ্ছে লর্ড সাদারটনের ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত নয় কি?
নিঃসন্দেহে, বললাম আমি। আর শোনো, সামান্স–এবার তো কাজকর্ম শুরু করে দিতে হয়। দাও তো দেখি আমার বিলগুলো আর আমার নতুন চেক বইটা!
দি ব্রাজিলিয়ান ক্যাট
সন্দেশ, শারদীয়া ১৩৮৯
-জন গহ্বরের বিভীষিকা
১৯০৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সাউথ কেনসিংটনের ৩৬ নং আপার কভেন্ট্রি ফ্ল্যাটে যক্ষ্মা রোগে ডাঃ জেস হার্ডকাসূলের মৃত্যুর পর, তাঁর কাগজপত্রের মধ্যে নিম্নলিখিত কাহিনীটি পাওয়া যায়। যাঁরা হার্ডকাকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন, তাঁরা একাহিনী সম্পর্কে কোনও মন্তব্য না করলেও, অন্তত এটুকু একবাক্যে স্বীকার করেন যে, হার্ডকাল একজন সুস্থমস্তিষ্ক বৈজ্ঞানিক-বুদ্ধিসম্পন্ন লোক ছিলেন; তাঁর পক্ষে নিছক মনগড়া কতগুলো আজগুবি ঘটনাকে বাস্তব বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা খুবই অস্বাভাবিক ছিল।
লেখাটা পাওয়া যায় একটা খামের মধ্যে। তার শিরোনামায় বলা হয়েছে–গত চৈত্র মাসে উত্তর-পশ্চিম ডার্বিশায়ারে অ্যালারটনদের ফার্মের নিকটবর্তী স্থানের একটি ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। বন্ধ খামের পিছনে ছিল পেনসিলে লেখা এই চিঠি–
প্রিয় সিটন,
শুনে আঘাত পাবে কিনা জানি না আমার কাহিনী তুমি অবিশ্বাস করার ফলে আমি সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত আর কারুর কাছে কোনও উল্লেখ করিনি। হয়তো বা আমার মৃত্যুর পর শেষ পর্যন্ত কোনও অপরিচিত ব্যক্তি এই কাহিনীর উপযুক্ত মর্যাদা দেবে, যে মর্যাদা থেকে আমার বন্ধু আমায় বঞ্চিত করেছিল।