বাঘের উত্তেজনা যেন ক্রমেই বাড়ছে, হাঁটার গতিও বাড়ছে সেইসঙ্গে, তার অস্থির পদক্ষেপ বারবার তাকে নিয়ে আসছে আমার লৌহাসনের ঠিক নীচে। আশ্চর্য এই ছায়াসদৃশ বিশাল শ্বাপদের নিঃশব্দ গতি! এদিকে লণ্ঠনের আলো এতই মৃদু যে, তাতে বাঘকে প্রায় দেখাই যায় না। অবশেষে একবার দপ করে জ্বলে উঠে লণ্ঠনটা নিভেই গেল। সূচিভেদ্য অন্ধকারে এখন শুধু আমি আর বাঘ।
বিপদের সামনে পড়ে যদি বুঝতে পারি যে, আমার যথাসাধ্য আমি করেছি, তা হলে শুধু পরিণতির অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। বর্তমান ক্ষেত্রে আমি যেখানে যে অবস্থায় আছি, সেটাই হল আমার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। আমি সেইভাবেই হাত-পা গুটিয়ে প্রায় দমবন্ধ করে পড়ে রইলাম। আশা আছে আমার অস্তিত্ব জানান না দিলে বাঘ হয়তো আমার কথা ভুলে যাবে। আন্দাজে মনে হয় দুটো বাজতে চলল। ভোর হবে চারটায়। দিনের আলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও দু ঘণ্টা।
বাইরে ঝড় চলেছে পুরোমাত্রায়। বৃষ্টির জল এসে আছড়ে পড়ছে জানলার গায়ে। ঘরের ভিতরে রাক্ত জান্তব গন্ধে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। বাঘ এখন আমার কাছে অদৃশ্য। তার কোনও শব্দ আসছে না আমার কানে। আমি বাঘের চিন্তা মন থেকে দূর করে অন্য কথা ভাবার চেষ্টা করলাম। একটি চিন্তাই স্থান পেল মনে; সেটা হল আমার খুড়তুতো ভাইটির শয়তানি, তার চরম বিশ্বাসঘাতকতা, আর আমার প্রতি তার গভীর বিদ্বেষের ভাব। ওই গালভরা হাসির পিছনে লুকিয়ে আছে এক নৃশংস খুনি। যতই ভাবলাম, ততই তার পরিকল্পনার চাতুরিটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে এল। সকলের সঙ্গে সেও চলে গিয়েছিল শুতে, তারপর গোপনে ফিরে এসে আমাকে তার বাঘের ঘরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রেখে চলে যায়। অত্যন্ত সহজেই সে ঘটনাটা বুঝিয়ে দেবে আর পাঁচজনকে। বিলিয়ার্ড রুমে বসে চুরুটটা শেষ করে তবে আমি উঠব; সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গুডনাইট করে চলে যায়। আমি নিজের খেয়ালবশত দিনের শেষে একবার বাঘটা দেখতে যাই, খাঁচা খোলা আছে না জেনে ঘরে ঢুকি, আর তার ফলেই ফাঁদে পড়ি। এর জন্য তাকে দায়ী করবে কে? আর যদি বা তার উপর সন্দেহ হয়–প্রমাণ তো নেই!
দু ঘণ্টা সময় যেন কাটতেই চায় না। একবার একটা খস্ খস্ শব্দে বুঝলাম বাঘ তার নিজের গায়ের লোম চাটছে। বার কয়েক একজোড়া সবুজ আলো দেখে মনে হল সে আমার দিকে চাইছে, কিন্তু তাও বেশিক্ষণের জন্য নয়। ক্রমে একটা বিশ্বাস দানা বাঁধতে লাগল যে, সে হয়তো আমার অস্তিত্ব ভুলে গেছে; কিংবা আমাকে অগ্রাহ্য করা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশেষে জানলা দিয়ে একটা ক্ষীণ আলো ঘরে প্রবেশ করল। প্রথমে দেখলাম দেয়ালের গায়ে এক জোড়া ধূসর চতুষ্কোণ; তারপর সে-দুটো ক্রমে সাদায় পরিণত হল; তারপর আমার সহবাসিন্দাটি প্রতীয়মান হবার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম বাঘও আমার দিকে চেয়ে আছে।
দৃষ্টি বিনিময়ের পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলাম যে শেষ দেখার সময় যা মনে হয়েছিল, বাঘের। মেজাজ তার চেয়ে শতগুণে বেশি ভয়ংকর। ভোরের শীত তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না; তার উপর সে হয়তো ক্ষুধার্ত। ঘরের ওপাশটায় অনবরত গর্জনের সঙ্গে সে দ্রুত পায়চারি করছে। পাথরের মেঝের উপর বার বার আছড়ে পড়ছে তার লেজ। কোণ অবধি গিয়ে উলটো মুখে ঘোরার সময় তার নির্মম দৃষ্টি চলে আসছে আমার দিকে। বুঝতে পারলাম আমাকে সে আস্ত রাখবে না। কিন্তু এইরকম হতাশার মুহূর্তেও এই ভয়াল পশুর গতিবিধির আশ্চর্য সাবলীলতা, তার পেশল দেহের ভাস্কর্যসুলভ সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ না করে পারল না। এদিকে চাপা গর্জন ক্রমে অসহিষ্ণু হুঙ্কারে পরিণত হচ্ছে, বেশ বুঝতে পারছি আমার অন্তিম সময় উপস্থিত।
এইভাবেই কি শেষে মরতে হবে–এই লোহার গরাদের উপর শুয়ে শীতে কম্পমান অবস্থায়? আমার অন্তরাত্মাকে এই শোচনীয় অবস্থার উর্ধ্বে উত্তরণের চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে, একজন মুমূর্ষ ব্যক্তির চিন্তায় যে স্বচ্ছতা আসে তার সাহায্যে ভাবতে চেষ্টা করলাম আত্মরক্ষার কোনও উপায় আছে কিনা। ভেবে একটা জিনিসই মনে হল যে, খাঁচার দেয়ালটা কোনওরকমে বাইরে থেকে আবার ভিতরে এনে বসিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে সেটাই হবে বাঁচার একমাত্র পথ। ওটাকে কি টেনে আনা যায়? এদিকে এও বুঝতে পারছি যে, অঙ্গ সঞ্চালনার সামান্য ইঙ্গিতেই বাঘ হয়তো আমাকে আক্রমণ করে বসবে।
অত্যন্ত সন্তর্পণে ডান হাতটা বাড়িয়ে খাঁচার দেয়ালের যে দিকটা ঘরের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল সেটাকে ধরলাম। আশ্চর্য এই যে, একটা টান দিতেই সেটা খানিকটা এগিয়ে এল আমার দিকে। কিন্তু আমি যে অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছি তাতে খুব বেশি জোর দিয়ে টানা সম্ভব নয়। আরেকবার টান দিতে ইঞ্চি তিনেক ঢুকে এল দেয়ালটা। এবার বুঝলাম দেয়ালের তলায় চাকা লাগানো রয়েছে। আরেকবার দিলাম টান–সেই মুহূর্তেই বাঘটা দিল লাফ।
ব্যাপারটা এত আচমকা ঘটল যে, আমি টেরই পাইনি। শুধু কানে এল একটা হুঙ্কার, আর সেইসঙ্গে আমার চোখের সামনে দেখলাম এক জোড়া জ্বলন্ত হলুদ চোখ ও মিশকালো মুখে দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেরোনো একটা ললকে লাল জিভ। বাঘ লাফিয়ে পড়ার ফলে আমার লৌহাসন থরথর করে কেঁপে উঠেছে–মনে হয় এই বুঝি সবসুদ্ধ ভেঙে পড়ল। বাঘটা কিছুক্ষণ সেই অবস্থায় রইল, তার মাথা ও সামনের থাবা আমার থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে, আর পিছনের থাবা খাঁচার দেয়ালে একটা অবলম্বন খোঁজার চেষ্টায় অস্থির। কিন্তু লাফটা ঠিক জুতসই হয়নি। বাঘ সেই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকতে পারল না। প্রচণ্ড রাগে দাঁত খিঁচিয়ে জালে আঁচড় দিতে দিতে সে সশব্দে লাফিয়ে নেমে পড়ল মেঝেতে। কিন্তু তার পরেই আবার আমার দিকে ফিরে দ্বিতীয়বার লক্ষ্যের জন্য প্রস্তুত হল।