এদিকে মালিক এসে পড়েছেন। কাণ্ড দেখে তিনি হন্তদন্ত নাসিরুদ্দিনের দিকে ছুটে এসে বললেন, ব্যাপারটা কী?
নাসিরুদ্দিন বললে, ঝড়ে উড়িয়ে এনে ফেলেছে আমায় এখানে।
আর খেতের সবজিগুলোকে উপড়ে ফেলল কে?
ওড়ার পথে ওগুলিকে খামচে ধরে তবে তো রক্ষা পেলাম।
আর সবজিগুলো থলের মধ্যে গেল কী করে?
সেই প্রশ্নই তো আমাকেও চিন্তায় ফেলেছিল, এমন সময় আপনি এসে পড়লেন।
.
৮.
মোল্লাগিন্নি মাঝরাত্তিরে নাসিরুদ্দিনের ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, ব্যাপার কী? চশমা পরে ঘুমোচ্ছ কেন?
মোল্লা নতুন চশমা নিয়েছে। খাপ্পা হয়ে বললে, চোখে চালশে পড়েছে, চশমা ছাড়া স্বপ্ন দেখব কী করে?
.
৯.
থলেতে একঝুড়ি ডিম লুকিয়ে নিয়ে নাসিরুদ্দিন চলেছে ভিনদেশে। সীমানায় পৌঁছতে শুল্ক বিভাগের লোক তাকে ধরলে। নাসিরুদ্দিন জানে ডিম চালান নিষিদ্ধ।
মিথ্যে বললে মৃত্যুদণ্ড বললে শুল্ক বিভাগের লোক। তোমার থলেতে কী আছে বলো।
প্রথম অবস্থার কিছু মুরগি, বললে মোল্লাসাহেব।
হুম–সমস্যার কথা। মুরগি চালান নিষিদ্ধ কিনা খোঁজ নিতে হবে, তারপর ব্যাপারটার মীমাংসা হবে। ততদিন এ থলি রইল আমাদের জিম্মায়। ভয় নেই, তোমার মুরগিকে উপোস রাখব না আমরা।
কিন্তু আমার মুরগির জাত যে একটু আলাদা, বললে নাসিরুদ্দিন।
কীরকম।
আপনারা তো শুনেছেন অবহেলার দরুন মুরগির অকাল বার্ধক্য আসে।
তা শুনেছি বটে!
আমার মুরগিকে ফেলে রাখলে সেগুলো অকালে শিশু হয়ে যায়!
শিশু মানে?
একেবারে শিশু, বললে নাসিরুদ্দিন, যাকে বলে ডিম।
.
১০.
মোল্লা মসজিদে গিয়ে বসেছে, তার জোব্বাটা কিঞ্চিৎ খাটো দেখে তার পিছনের লোক সেটাকে টেনে খানিকটা নামিয়ে দিলে। মোল্লা তৎক্ষণাৎ তার সামনের লোকের জোব্বাটা ধরে নীচের দিকে দিলে এক টান। তাতে লোকটি পিছন ফিরে চোখ রাঙিয়ে বললে, এটা কী হচ্ছে?
মোল্লা বললে, এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে আমার পিছনের লোক।
.
১১.
কারও মৃত্যু হলে শোক জানানোর জন্য কালো পোশাক পরে মোল্লার দেশের লোকেরা। মোল্লাকে সেই পোশাকে হাঁটতে দেখে একজন জিজ্ঞেস করলে, কেউ মরল নাকি, মোল্লাসাহেব?
সাবধানের মার নেই, বললে মোল্লাসাহেব, কোথায় কখন কে মরছে তা কি কেউ বলতে পারে?
.
১২.
নাসিরুদ্দিন রাজাকে একটা সুখবর দেবে, তাই অনেক কসরৎ করে রাজসভায় গিয়ে হাজির হয়েছে। রাজা খবর শুনে খুশি হয়ে বললেন, কী বকশিশ চাও বলো।
পঞ্চাশ ঘা চাবুক, বললে নাসিরুদ্দিন।
রাজা অবাক! তবে নাসিরুদ্দিন যে মশকরা করছে না সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যায়। হুকুম হল পঞ্চাশ ঘা চাবুকের।
পঁচিশ ঘায়ের পর নাসিরুদ্দিন বললে, থামো!
চাবুক থামল। বাকি পঁচিশ ঘা পাবে আমার অংশীদার, বললে নাসিরুদ্দিন। রাজপেয়াদা আমার সঙ্গে কড়ার করেছিল সুখবর পেয়ে রাজা বকশিশ দিলে তার অর্ধেক তাকে দিতে হবে।
সন্দেশ, মাঘ ১৩৮৭
আর এক দফা মোল্লা নাসিরুদ্দিন
১.
নাসিরুদ্দিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, পাশে ফুলে ফলে ভরা বাগিচা দেখে তার মধ্যে গিয়ে ঢুকল। প্রকৃতির শোভাও উপভোগ করা হবে, শর্টকাটও হবে।
কিছুদূর যেতে না যেতেই নাসিরুদ্দিন এক গর্তের মধ্যে পড়ল, আর পড়তেই তার মনে এক চিন্তার উদয় হল।
ভাগ্যে পথ ছেড়ে বনে ঢুকেছিলাম, ভাবলে নাসিরুদ্দিন। এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশেই যদি এমন বিপদ লুকিয়ে থাকে, তা হলে না-জানি ধুলোকাদায় ভরা রাস্তায় কত নাজেহাল হতে হত!
.
২.
মোগ্লাগিন্নি একটা শব্দ পেয়ে ছুটে গেছে তার স্বামীর ঘরে।
কী হল? কীসের শব্দ?
আমার জোব্বাটা মাটিতে পড়ে গে, বললে মোল্লাসাহেব।
তাতেই এত শব্দ?
আমি ছিলাম জোব্বার ভেতর।
.
৩.
নাসিরুদ্দিন একদিন রাজসভায় হাজির হল মাথায় এক বিশাল বাহারের পাগড়ি নিয়ে। তার মতলব সে রাজাকে পাগড়িটা বিক্রি করবে।
তোমার ওই আশ্চর্য পাগড়িটা কত মূল্যে খরিদ করলে মোল্লাসাহেব? রাজা প্রশ্ন করলেন।
সহস্র স্বর্ণমুদ্রা, শাহেন শা!
এক উজির মোল্লার মতলব আঁচ করে রাজার কানে ফিসফিস করে বললে, মুগ্ধ না হলে কেউ ওই পাগড়ির জন্য অত দাম দিতে পারে না, জাঁহাপনা।
রাজা মোল্লাকে বললেন, অত দাম কেন? একটা পাগড়ির জন্য এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা যে অবিশ্বাস্য।
মূল্যের কারণ আর কিছুই না, জাঁহাপনা, বললে নাসিরুদ্দিন, আমি জানি দুনিয়ায় কেবল একজন বাদশাই আছেন যিনি এই পাগড়ি খরিদ করতে পারেন।
তোষামোদে খুশি হয়ে রাজা তৎক্ষণাৎ মোল্লাকে দুহাজার স্বর্ণমুদ্রা দেবার ব্যবস্থা করে নিজে পাগড়িটা কিনে নিলেন।
মোল্লা পরে সেই উজিরকে বললে, আপনি পাগড়ির মূল্য জানতে পারেন, কিন্তু আমি জানি রাজাদের দুর্বলতা কোথায়।
.
৪.
বোগদাদের খালিফের প্রাসাদে ভোজ হবে, তিন হাজার হোমরা-চোমরার নেমন্তন্ন হয়েছে। ঘটনাচক্রে নাসিরুদ্দিনও সেই দলে পড়ে গেছে।
খালিফের বাড়িতে ভোজ, চাট্টিখানি কথা নয়! অতিথি সৎকারে খালিফের জুড়ি দুনিয়ায় নেই। তেমনি তাঁর বাবুর্চিটিও একটি প্রবাদপুরুষ। তার রান্নার যেমনি স্বাদ, তেমনি গন্ধ, তেমনি চেহারা।
সব খাদ্যের শেষে বিরাট পাত্রে এল একেকটি আস্ত ময়ূর। দেখে মনে হবে ময়ূর বুঝি জ্যান্ত, যদিও আসলে সেগুলো রোস্ট করা। ডানা, ঠোঁট, পুচ্ছ সবই আছে, আর সবকিছুই তৈরি রঙবেরঙের উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য দিয়ে।
নিমন্ত্রিতেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে আছে রন্ধনশিল্পের এই অপূর্ব নিদর্শনের দিকে, কেউই যেন আর খাবার কথা ভাবছে না।