অবশেষে আমার কবজি যখন যন্ত্রণায় অসাড়, আমার আঙুল ক্ষতবিক্ষত, তখন নিরুপায় হয়ে হাল ছাড়তে হল। একটা ঘটাং শব্দ করে খাঁচার দেওয়ালটা পুরো সরে গেল, আর তারপর শুনলাম টার্কিশ চটি পরা পায়ের শব্দ মিলিয়ে গিয়ে প্যাসেজের শেষ প্রান্তের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। তারপর আর শব্দ নেই।
এতক্ষণ জানোয়ারটা অনড় ভাবেই বসে ছিল খাঁচার এক কোণে। তার লেজ আর নড়ছে না। তার সামনে দিয়ে একটা মানুষকে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে–এ দৃশ্য নিশ্চয়ই তার ভারী অদ্ভুত লেগেছিল। তার বিশাল চোখ দুটি এখন আমার দিকে চাওয়া। শিকটা ধরার সময় লণ্ঠনটা মেঝেতে নামিয়ে রেখেছিলাম। মনে হল সেটা হাতে থাকলে তার আলোটা হয়তো আত্মরক্ষায় কিছুটা সাহায্য করবে; কিন্তু সেটা তুলতে যেই হাত নামিয়েছি অমনই বাঘটা একটা হুঙ্কার দিয়ে উঠল। আমি তৎক্ষণাৎ আতঙ্কে পাথর। বাঘের থেকে আমার দূরত্ব এখন মাত্র দশ ফুট। তার চোখ দুটো আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে। অদ্ভুত সে চাহনি; মনের গভীরে ত্রাসের সঞ্চার করলেও চোখ ফেরানো যায় না। চরম সংকটের মুহূর্তে প্রকৃতির আশ্চর্য খেয়ালে মনে হয় জ্বলন্ত গোলক দুটি যেন একবার আয়তনে বাড়ছে, একবার কমছে। আবার মনে হয় যে, অন্ধকারে দুটি উজ্জ্বল বিন্দু ক্রমে বড় হতে হতে ঘরের ওই বিশেষ অংশটিতে একটা ভৌতিক আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর তারপরেই দেখি আলো নেই।
অর্থাৎ জানোয়ার চোখ বন্ধ করেছে। মানুষের অপলক দৃষ্টিতে এক অমোঘ শক্তি আছে, এমন একটা প্রচলিত ধারণায় কোনও সত্য আছে কিনা জানি না; হয়তো বা জানোয়ারটার মধ্যে একটা তার ভাব এসেছিল। মোট কথা, আক্রমণের কোনও চেষ্টার বদলে সেটা দিব্যি পায়ের উপর মাথা রেখে ঘুমোচ্ছ বলেই মনে হয়। পাছে তার মধ্যে আবার হিংস্রভাব জেগে ওঠে, তাই আমিও সম্পূর্ণ অনড় হয়ে রইলাম। ওই ভয়ংকর চোখ দুটো আমার চোখের সামনে না থাকায় এখন তবু মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে পারছি। এই পৈশাচিক জানোয়ারের সঙ্গে সারারাত সহবাস করতে হবে আমাকে। আমার নিজের মন বলছে, এবং যার জন্য আমার এই দশা তার কথাতেও বুঝেছি যে, এই জানোয়ার। তার মনিবের মতোই মারাত্মক। কাল সকাল পর্যন্ত একে ঠেকিয়ে রাখব কী করে? দরজা তো খুলবেই না, আর ওই শিকওয়ালা খুপচি জানলাও আমার কোনও কাজে আসবে না। আমাকে বাঁচাও বলে তারস্বরে চেঁচিয়ে কোনও লাভ নেই, কারণ আমি এখন যে অংশটাতে রয়েছি সেটা বাড়ির বাইরে; সেই বাড়ি আর ব্যাঘ্রাবাসের মধ্যে যে প্যাসেজটা রয়েছে সেটা প্রায় একশো ফুট লম্বা। তা ছাড়া এই ঝড়বাদলের শব্দের মধ্যে আমার চিৎকার শুনবে কে? একমাত্র ভরসা আমার সাহস ও উপস্থিতবুদ্ধি।
ঠিক এই মুহূর্তে আমার অসহায়ভাব দ্বিগুণ বেড়ে গেল লণ্ঠনের দিকে চোখ পড়াতে। বাতির যে এখন শেষ অবস্থা সেটা শিখার অস্থিরতা থেকেই বোঝা যায়। এর আয়ু দশ মিনিট। যা করার এর মধ্যেই, কারণ অন্ধকারে ওই জানোয়ারের সঙ্গে একা পড়লে তখন আর সুস্থমস্তিষ্কে কিছু করার অবস্থা থাকবে না। কথাটা ভাবতেই আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অসাড় হয়ে এল। দিশেহারা ভাবে এদিক-ওদিক চাইতে একটা জিনিসের উপর চোখ পড়াতে একটা ক্ষীণ আশার উদ্রেক হল। এতে সংকট থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি না পেলেও, অন্তত সাময়িক নিরাপত্তার একটা সম্ভাবনা আছে।
আগেই বলেছি যে, খাঁচার দুটো অংশ ছিল–একটা ছাত ও একটা সামনের দেয়াল। দেয়ালটা বাইরে বার করে নিলেও, ছাতের অংশটা ভিতরেই থেকে যায়। এই ছাতেও কয়েক ইঞ্চি অন্তর অন্তর একটা করে লোহার শিক, আর শিকের মধ্যে ফাঁকগুলো ভরা লোহার জাল দিয়ে। সেই আচ্ছাদনের নীচে খাঁচার এক কোনায় এখন বসে আছে বাঘটা। খাঁচার ছাত আর ঘরের সিলিং-এর মধ্যে হাত দুয়েকের ব্যবধান। যদি কোনওরকমে ওই ছাতের উপর উঠতে পারি, তা হলে অন্তত পিছন থেকে, মাথার দিক থেকে, আর দুপাশ থেকে আমি নিরাপদ। খোলা থাকবে শুধু সামনের দিকটা। সেদিক থেকে বাঘ আমায় আক্রমণ করতে পারে ঠিকই, কিন্তু তা হলেও বলব যে, বাঘ যদি হঠাৎ ঘরে পায়চারি শুরু করে তা হলে আমাকে তার সামনে পড়তে হবে না। আমার নাগাল যদি তাকে পেতে হয় তা হলে কিছুটা কসরত করতে হবে। যা করার এইবেলা, কারণ বাতি নিভে গেলে কাজটা আমার। পক্ষে অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়বে।
যা থাকে কপালে করে, এক লাফে ছাউনির পাশটা দুহাতে খামচে ধরে দেহটাকে কোনওমতে। উপরে নিয়ে গিয়ে ফেললাম। আমার মুখ তখন দুই শিকের মাঝখানে জালের উপর; দেখতে পাচ্ছি বাঘের মুখ হাঁ, আর তার ভয়ংকর চোখ দুটো চেয়ে আছে সটান আমার দিকে, তার নিশ্বাসের বোঁটকা গন্ধে আমার নাক জ্বলছে।
জানোয়ারের ভাব দেখে কিন্তু মনে হল, রাগের চেয়ে তার কৌতূহলটাই যেন বেশি। এবারে সে তার দেহের মাংসপেশিতে ঢেউ খেলিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পিছনের দুপায়ে ভর করে একটা থাবা পিছনের দেয়ালে রেখে অন্যটা দিয়ে খাঁচার ছাতের জালের উপর দিয়ে একটা লম্বা আঁচড় টানল। তার ফলে তার নখ আমার পাতলুন ভেদ করে আমার হাঁটুতে একটা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করল। এটাকে আক্রমণ বলা চলে না, বরং আক্রমণের মহড়া মাত্র, কারণ আমার আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে সে থাবা নামিয়ে নিয়ে এক লাফে খাঁচা থেকে বেরিয়ে সারা ঘর জুড়ে দ্রুত পায়চারি শুরু করে দিল। তারই ফাঁকে ফাঁকে তার দৃষ্টি বারবার চলে আসছে আমার দিকে। আমি দেহ সঙ্কুচিত করে নিজেকে একেবারে দেয়ালের সঙ্গে সিটিয়ে দিলাম। যত পিছিয়ে থাকব, ততই তারপক্ষে আমার নাগাল পাওয়া কঠিন হবে।