কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ও আমাকে চমকে দিয়ে দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকে আবার তৎক্ষণাৎ সেটা বন্ধ করে দিল। তার কণ্ঠস্বর শুনে বিশাল জানোয়ারটা উঠে দাঁড়িয়ে হাই তুলে নিজের মাথাটা এভারার্ডের গায়ে ঘষতে লাগল, আর এভারার্ডও জানোয়ারটার গায়ে হাত বুলোতে লাগল।
এবার দেখি টমি বাবু, খাঁচায় ঢোকো তো!
আদেশ শোনামাত্র কৃষ্ণকায় জীবটি ঘরের একপাশে গিয়ে একটি গরাদের ছাউনির তলায় কুণ্ডলী পাকিয়ে বসল। তারপর এভারার্ড বাইরে এসে হাতলটা ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে প্যাসেজে বেরিয়ে থাকা ফ্রেমবদ্ধ লোহার শিকের সারি দেয়ালের একটা ফাটল দিয়ে বাঘের ঘরে ঢুকে ছাউনির সঙ্গে লেগে গিয়ে দিব্যি একটি খাঁচার সৃষ্টি করল। এবার এভারার্ড দরজা খুলে আমাকে ভিতরে ডাকল। এই বিশেষ শ্রেণীর পদের ঘরে যে বিশেষ গন্ধ পাওয়া যায়, এই ঘর এখন সেই গন্ধে ভরপুর।
এটাই ব্যবস্থা, বলল এভারার্ড। দিনের বেলা ও সমস্ত ঘরটাতেই পায়চারি করে, রাত্রে একপাশে খাঁচাটায় পুরে দেওয়া হয়। বাইরে থেকে হাতল ঘোরালেই খাঁচার দেয়াল সরে গিয়ে ও ছাড়া পেয়ে যায়। আর যদি তা না চাও তো ওকে ওইভাবেই বন্দি করে রাখতে পারো। উহঁ উ ওরকম কোরো না।
আমি গরাদের মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে বাঘের গায়ে রাখতে গিয়েছিলাম, সে এক হ্যাঁচকা টানে। আমার হাতটা বার করে আনল।
ওকে বিশ্বাস নেই। আমি যা করি, আর পাঁচজনের তা করা চলে না। সবাইকে ও বন্ধু বলে মানতে রাজি নয়। তাই না টমি? হুঁ, এবারে লাঞ্চের গন্ধ পেয়েছেন বাবু। তাই না, টমি?
বাইরে প্যাসেজে পায়ের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে অপরিসর খাঁচাটার মধ্যে পায়চারি শুরু করে দিয়েছে। তার হলুদ চোখের চাহনি তীক্ষ্ণ ও অস্থির, তার লেলিহান জিভ বেরিয়ে পড়েছে হাঁ করা মুখের অসমান দাঁতের সারির ফাঁক দিয়ে। একজন পরিচারক পাত্রে একটি মাংসখণ্ড নিয়ে ঘরে এসে গরাদের মধ্যে দিয়ে সেটাকে খাঁচার ভিতর গলিয়ে দিল। বাঘ থাবা দিয়ে আলতো করে সেটাকে তুলে নিয়ে খাঁচার এক কোণে বসে সেটার সদ্ব্যবহার করতে শুরু করল। মাংস টেনে ছেঁড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে রক্ত মাখা মুখটা তুলে আমাদের দিকে চাইছে। আমিও একদৃষ্টে দেখছি এই বন্য দৃশ্য।
টমির উপর আমার টানের কারণটা বুঝলে তো? ঘর থেকে বেরিয়ে এসে প্রশ্ন করল এভারার্ড। হাজার হোক, আমার হাতেই তো ও মানুষ। কম ঝক্কি গেছে ওকে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এখানে আনতে? অবিশ্যি এখানে এসে ও ভালই আছে। যা বলছিলাম, এই বিশেষ বাঘের এর চেয়ে ভাল নমুনা ইউরোপে আর নেই। চিড়িয়াখানার কর্তারা একে নেবার জন্য ঝুলোঝুলি করছে। কিন্তু আমি ওকে ছাড়ছি না। যাক গে, আমার মনের কথা ঢের বলা হল, এবার চলো টমির মতো আমরাও গিয়ে লাঞ্চ করি।
দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা আমার এ ভাইটি তার জন্তুজানোয়ার নিয়ে এতই মশগুল যে, সে-জগতের বাইরে যে আর একটা জগৎ থাকতে পারে সেটা ভাবাই মুশকিল। কিন্তু সেটা যে রয়েছে সেটা বুঝতে পারতাম তার পাওয়া টেলিগ্রামের বহর থেকে। দিনের যে কোনও সময় আসত এই টেলিগ্রাম, আর তার প্রত্যেকটি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে খুলত এভারার্ড নিজেই। একেকবার মনে। হত সেগুলো হয়তো ঘোড়ার মাঠ বা স্টক মার্কেট সংক্রান্ত কোনও খবর। মোট কথা, এটা বোঝাই যেত যে এমন কিছু কারবারের সঙ্গে সে জড়িত রয়েছে যেটা ঘটছে সাফোকের বাইরে। আমি যে, ছদিন ছিলাম তার মধ্যে দিনে চারখানা করে টেলিগ্রাম তো এসেইছে, একদিন এল সাতখানা।
এই ছদিন এত ভালভাবে কেটেছে যে ভাইয়ের সঙ্গে একটা চমৎকার সমঝোতা হয়ে গিয়েছিল। প্রতি রাতে বিলিয়ার্ড রুমে বসে এভারার্ড তার আশ্চর্য ভ্রমণকাহিনী শোনাত আমাকে। শুনে বিশ্বাস করা বেশ কঠিন হত যে, আমার এই নিরীহ ভাইটিই এইসব রোমহর্ষক ঘটনার নায়ক। তার। অভিজ্ঞতার পরিবর্তে আমি তাকে শোনাতাম গ্রোভনর ম্যানসনসের জীবনযাত্রার খবর। তাতে সে এতই মুগ্ধ হত যে, বারবার বলত একবার লন্ডনে এসে আমার বাসস্থানে কটা দিন কাটিয়ে যাবে। লন্ডনের চঞ্চল জীবনযাত্রা সম্বন্ধে দেখতাম তার একটা অদম্য কৌতূহল রয়েছে। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে আমার চেয়ে ভাল গাইড সে পাবে না।
শেষ দিনে আমি আর কথাটা না বলে পারলাম না। সরাসরি বলে দিলাম যে আমার আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, এবং সম্পূর্ণ দেউলে হতে আমার আর বেশিদিন বাকি নেই। আমি যদিও তার কাছে পরামর্শই চাইলাম, যেটা আসলে দরকার ছিল সেটা হল বেশ খানিকটা ক্যাশ টাকা।
কিন্তু তুমিই তো লর্ড সাদারটনের উত্তরাধিকারী, তাই না? প্রশ্ন করল এভারার্ড।
আমার তো তাই ধারণা, কিন্তু তিনি আমাকে এক কপর্দকও দেননি কখনও।
জানি, বলল এভারার্ড। সে যে কত কঞ্জুস সে কথা আমি শুনেছি। সত্যি তো, তোমার অবস্থা বেশ কাহিল বলে মনে হচ্ছে। ভাল কথা, সাদারটনের স্বাস্থ্য এখন কেমন?
ছেলেবেলা থেকেই তো শুনে আসছি সে অত্যন্ত রুগ্ণ।
হুঁ…তাও ট্যাঙস ট্যাঙস করে চালিয়ে যাচ্ছে। বেচারা তুমি!
আমার বড় আশা ছিল তুমি সব শুনে-টুনে হয়তো কিছু—
আর বলতে হবে না, হেসে বলল এভারার্ড। আজ রাত্রে এ-বিষয়ে কথা হবে। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব করব, কথা দিচ্ছি।
আমার যে বিদায় নেবার সময় এসে গেছে তাতে আমার আক্ষেপ নেই, কারণ জানি যে এ বাড়িরই একজন বাসিন্দা আমাকে তাড়াতে পারলে বাঁচে। কিং গৃহিণীর বিষদৃষ্টি আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। তিনি যে আগ বাড়িয়ে আমাকে অপমান করেন তা নয়; সেখানে স্বামীর ভয় তাঁকে বেশিদূর এগোতে দেয় না। কিন্তু চরম ঈষার বশে তিনি আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছেন, এবং গ্রেল্যান্ডসে আমার অবস্থান যাতে সবদিক দিয়ে অস্বস্তিকর হয়, সে চেষ্টার কোনও ত্রুটি করেন না। বিশেষত শেষ দিনে তাঁর ব্যবহার এমনই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গেল যে, এভারার্ডের কাছ থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি না পেলে আমি সেইদিনই দুপুরের গাড়িতে রওনা দিয়ে দিতাম।