আমিও ছাড়বার পাত্র নই। বললাম, আমার বিশ্বাস এভারার্ড যদি মনে করে আমি তার আতিথেয়তার অন্যায় সুযোগ নিচ্ছি তা হলে সে কথা সে নিশ্চয়ই আমাকে বলবে।
ব্যাপার কী?
ঘরে ফিরে এসেছে এভারার্ড। মনে হল আমার কথাগুলো সে শুনেছে, এবং আমাদের দুজনের দিকে চেয়ে সে পরিস্থিতিটা আঁচ করে নিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে তার খুশিতে ভরা গোল মুখটায় এক
অনির্বচনীয় হিংস্রভাব ফুটে উঠল।
তুমি একটু বাইরে যাবে কি, মাশাল? (আমার নাম যে মাশাল কিং সেটা এইবেলা বলে রাখি)।
আমি বেরোতে আমার পিছনের দরজাটা বন্ধ করে দিল এভারার্ড, আর তারপরেই শুনলাম তীব্র ভর্ৎসনার সুরে সে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছে। আতিথেয়তার অবমাননায় সে যে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ তাতে সন্দেহ নেই। আড়ি পাতার কোনও অভিসন্ধি ছিল না আমার, তাই আমি বারান্দা থেকে নেমে এলাম বাগানে! কিছুক্ষণ পরে দ্রুত পায়ের আওয়াজ শুনে ঘুরে দেখি মহিলা বাইরে বেরিয়ে এসেছেন, তাঁর মুখ বিবর্ণ, দৃষ্টি বিস্ফারিত।
আমার স্বামী আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন, মিঃ মাশাল, দৃষ্টি না তুলে বললেন মহিলা।
আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, দোহাই মিসেস কিং, এ নিয়ে আর কিছু বলবেন না।
তাঁর কালো চোখদুটো হঠাৎ ঝলসে উঠল।
মূর্খ!
চাপা অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে কথাটা বলে সদর্পে ঘরের ভিতর চলে গেলেন মহিলা।
অপমানটা এতই অপ্রত্যাশিত, এত অসহ্য যে, আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম দরজার দিকে। এমন সময় এভারার্ড এল বারান্দায়।
আশা করি আমার স্ত্রী তার অবাচীন ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়েছে তোমার কাছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ–চেয়েছেন বইকী! এভারার্ড কনুইটাকে তার হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
তুমি ব্যাপারটা গায়ে মেখে না, বলল এভারার্ড। তোমার মেয়াদের একটি ঘণ্টাও কম যদি থাকো তুমি এখানে তা হলে আমি অত্যন্ত দুঃখ পাব। ব্যাপারটা হচ্ছে কী–ভাইয়ের কাছে গোপন করার কোনও মানে হয় না–আমার স্ত্রী অত্যন্ত ঈর্ষাপরায়ণ। আমাদের দুজনের মাঝখানে কেউ এসে দাঁড়ালেই সেটা ও আর বরদাস্ত করতে পারে না, তা সে লোক পুরুষই হোক আর মহিলাই হোক। ও সবচেয়ে কীসে খুশি হয় জানো?–স্বামী-স্ত্রীতে সমুদ্রের মাঝখানে কোনও জনবিহীন দ্বীপে বসে গল্প করে যদি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিই, তা হলে। এর থেকেই বুঝতে পারবে ও মানুষটা কেমন। আসলে এটা একটা ব্যারামের শামিল। তুমি কথা দাও, এ নিয়ে আর চিন্তা করবে না।
মোটেই না।
তা হলে এই চুরুটটা ধরিয়ে আমার সঙ্গে এসো। আমার পশুসংগ্রহটা দেখাই তোমাকে।
সারা বিকেলটা কেটে গেল এই কাজে। বাইরের থেকে আনা যত পাখি, যত সরীসৃপ, সবই দেখা হল। এদের মধ্যে কিছু রয়েছে খাঁচায়, কিছু খাঁচার বাইরে, আর কিছু একেবারে বাড়ির ভিতর ছাড়া-অবস্থায়। চলতে চলতে সামনে ঘাস থেকে হঠাৎ কোনও রঙব্রেঙের পাখি লাফিয়ে উঠতে দেখে, বা কোনও অচেনা জানোয়ারকে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়তে দেখে ছেলেমানুষের মতো উল্লসিত হয়ে উঠছিল এভারার্ড। সবশেষে প্রাসাদের এক প্রান্তে একটি লম্বা প্যাসেজের ভিতর গিয়ে পৌঁছলাম আমরা। প্যাসেজের শেষ মাথায় একটি খড়খড়ি লাগানো ভারী দরজা, আর তার পাশেই একটা হাতল লাগানো চাকা। সেইসঙ্গে লক্ষ করলাম, লোহার ফ্রেমে লাগানো এক সারি খাড়াখাড়ি লোহার শিক দাঁড়িয়ে রয়েছে প্যাসেজের ভিতর।
এবার যেটা দেখাব সেটা হল আমার সংগ্রহের একেবারে সেরা জিনিস, বলল এভারার্ড। ইউরোপে আর একটিমাত্র নমুনা আছে এই জিনিসের। রটারড্যামে একটা বাচ্চা ছিল, সেটা মরে গেছে। জিনিসটা হল একটা ব্রেজিলিয়ান বাঘ।
তার সঙ্গে অন্য বাঘের তফাত কোথায়?
সেটা এখুনি দেখতে পাবে, হেসে বলল কিং। খড়খড়িটা তুলে একবার ভিতরে দেখবে কি?
দরজার গায়ের খড়খড়ি ফাঁক করে চোখ লাগাতেই দেখলাম একটি বেশ বড় ঘর। তার মেঝেতে পাথর বসানো, তার দেয়ালের উপর দিকে শিক দেওয়া ছোট্ট জানলা। ঘরের মাঝখানে মেঝের উপর বসে রোদ পোয়াচ্ছে একটি জানোয়ার। সেটা বাঘের মতোই বড়, যদিও গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। আয়তন বিশাল হলেও ভঙ্গিটা দেখে পোষা বেড়ালের কথাই মনে হয়। তার দেহের সুঠাম, পেশল গড়ন, বীর্যের সঙ্গে কমনীয়তার আশ্চর্য সমাবেশ, আমাকে এমন মুগ্ধ করল যে, আমি জানোয়ারের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।
জাঁদরেল জানোয়ার, নয় কি? প্রশ্ন করল এভারার্ড।
নিঃসন্দেহে, বললাম আমি। এমন আশ্চর্য জানোয়ার দেখিনি কখনও।
কেউ কেউ এটাকে পুমা বলে। কিন্তু আসলে এটা মোটেই পুমা নয়। এটা মাথা থেকে লেজের ডগা অবধি আঠারো ফুট। চার বছর আগে এটা ছিল দুটো ড্যাবড্যাবে হলদে চোখ বসানো একটি কালো পশমের বল। রিও নিগ্রো নদীর কাছে এক আদিম অরণ্যে একজন এটা বিক্রি করেছিল আমাকে, মা-টাকে বল্লম দিয়ে মেরে ফেলে, যদিও তার আগে এগারোটি মানুষ গেছে তার পেটে।
তার মানে এরা বুঝি খুব হিংস্র হয়?
এমন শয়তান, এমন রক্তপিপাসু জানোয়ার আর দুটি নেই। দক্ষিণ আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের এই বাঘের কথা বললে দেখবে তারা কীরকম চমকে ওঠে। এই জানোয়ারের চেয়ে মানুষের উপর তাদের বিশ্বাস অনেক বেশি। ইনি এখনও মানুষের রক্তের স্বাদ পাননি, কিন্তু একবার পেলে এর চেহারাই বদলে যাবে। এখন পর্যন্ত আমাকে ছাড়া আর কাউকে বরদাস্ত করে না ওর ঘরে। ওর পরিচর্যা করে যে লোক বল্ডউইন–সেও ওর কাছে যেতে সাহস পায় না। ওর বাপ, মা দুই-ই হচ্ছি আমি।