গুম্ফায় ঠিক এই মুহূর্তে কী হচ্ছে সেটা অবিশ্যি জর্জের জানতে বাকি নেই। লামাপ্রবর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে যন্ত্রটার কাছে বসে আছেন। অপেক্ষাকৃত কমবয়স্করা তাঁদের সামনে এনে হাজির করছে যন্ত্র থেকে নতুন বেরিয়ে-আসা নামের তালিকা। লামারা নামগুলোর উপর চোখ বোলাচ্ছেন, তারপর সেগুলো কেটে কেটে খাতায় সেঁটে ফেলছেন। কারও মুখে কোনও কথা নেই, একমাত্র শব্দ হচ্ছে যান্ত্রিক টাইপরাইটারের, কারণ মার্ক-৫ কম্পিউটার প্রতি সেকেন্ডে হাজার হিসাবের কাজ করে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে। জর্জ ও চাক্ তিন মাস ধরে এই কাজ দেখেছে। তাদের যে মাথা খারাপ হয়ে যায়নি, এটা পরম ভাগ্যি।
ওই দেখো, বলে উঠল চা সামনের উপত্যকার দিকে হাত বাড়িয়ে। আহা, কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে বলো তো!
জর্জ মনে মনে ভাবল–সত্যিই সুন্দর। পুরনো ডি-সি-থ্রি বিমানটা রানওয়ের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটি রুপালি ক্রুশের মতো। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ওদের দুজনকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে সভ্য জগতে, যেখানে তারা পাবে মুক্তি। উৎকৃষ্ট সুরাপানে যে আনন্দ হয়, চিন্তাটা মাথায় আসতে জর্জ সেই আনন্দ অনুভব করল।
হিমালয়ের হঠাৎ-রাত্রি এখনই তাদের গ্রাস করবে। তবে সৌভাগ্যক্রমে রাস্তা ভাল, আর দৃজনের কাছেই রয়েছে টর্চ। একমাত্র যদি না শীত হঠাৎ বেড়ে গিয়ে অস্বস্তির কোনও কারণ ঘটায়, এ ছাড়া কোনও চিন্তা নেই। মাথার উপরে মেঘমুক্ত আকাশে অগণিত অতি পরিচিত নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। জর্জের একমাত্র দুশ্চিন্তা ছিল যে, প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য হয়তো প্লেন না উড়তে পারে; কিন্তু এখন সে দুশ্চিন্তাও দূর হয়েছে।
জর্জের গলা দিয়ে গান বেরিয়ে এল; তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। পর্বত পরিবেষ্টিত এই বিশাল প্রান্তরে গানটা যেন কিঞ্চিৎ বেমানান। সে রিস্টওয়াচের দিকে চাইল।
আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া উচিত, সে চেঁচিয়ে জানাল পিছনে চাক-এর উদ্দেশে। তারপর আরও কতগুলো কথা সে জুড়ে দিল। কম্পিউটারের কাজ শেষ হল কিনা কে জানে। এখনই তো হওয়ার কথা।
চাক-এর কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে জর্জ উলটোমুখে ঘুরল। সে দেখল ঘোড়ার পিঠে চাককে–তার দৃষ্টি আকাশের দিকে।
ওপরে চেয়ে দেখো, বলল চাক্।
জর্জ চাইল –হয়তো শেষবারের মতো।
মাথার উপরে সন্ধ্যার আকাশ থেকে নির্বিবাদে একটি একটি করে তারা মুছে যাচ্ছে।
দি নাইন বিলিয়ন নেমস্ অফ গড
সন্দেশ, কার্তিক ১৩৯১
ব্রেজিলের কালো বাঘ
মেজাজটা বনেদি, প্রত্যাশা অসীম, অভিজাত বংশের রক্ত বইছে ধমনীতে, অথচ পকেটে পয়সা নেই, রোজগারের কোনও রাস্তা নেই–একজন যুবকের পক্ষে এর চেয়ে দৃভাগ্য আর কী হতে পারে? আমার বাবা ছিলেন সহজ, সরল মানুষ। তাঁর দাদা, অকৃতদার লর্ড সাদারটন, বিশাল সম্পত্তির মালিক। এই দাদার বদান্যতার উপর বাবার এমনই আস্থা ছিল যে তাঁর একমাত্র সন্তান হয়ে আমার যে কোনওদিন অন্নসংস্থানের চিন্তা করতে হবে এটা তিনি ভাবতে পারেননি। তাঁর ধারণা ছিল, হয় সাদারটনের বিস্তীর্ণ জমিদারি এস্টেটে, না হয় নিদেনপক্ষে সরকারের কূটনৈতিক বিভাগে আমার। একটা স্থান হবেই। তাঁর অনুমান যে সম্পূর্ণ ভুল সেটা তাঁর অকালমৃত্যুর ফলে বাবা আর জেনে যেতে পারেননি। যেমন আমার জ্যাঠা, তেমনই ব্রিটিশ সরকার, আমার সংগতির জন্য কিছুই করলেন না, বা আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনও তাপ উত্তাপ প্রকাশ করলেন না। কচিৎ কদাচিৎ কিছু ফেজান্ট পাখি বা গুটিকয়েক খরগোশ উপঢৌকন হিসেবে জ্যাঠার কাছ থেকে আসে, আর সেই থেকেই বোঝা যায় যে আমি ইংল্যান্ডের অন্যতম সবচেয়ে সমৃদ্ধ জমিদারিতে অবস্থিত অটওয়েল প্রাসাদের উত্তরাধিকারী। যাই হোক, আমি নিজে বিয়ে করিনি, লন্ডনের গ্রোভনর ম্যানসনসে ঘর নিয়ে নাগরিক জীবন যাপন করি। কাজের মধ্যে আছে পায়রা শিকার ও হার্লিং হ্যামে পোলা খেলা। আমার ঋণ যে মাসে মাসে বেড়েই চলেছে, কিছুদিন পরে আর তা শোধ করার কোনও উপায়ই থাকবে না, এটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আমার এই শোচনীয় অবস্থাটা আরও প্রকট হয়ে উঠছে এই কারণেই যে লর্ড সাদারটন ছাড়াও আমার আরও বেশ কয়েকজন ধনী আত্মীয় রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে নিকট হলেন আমার খুড়তুতো ভাই এভারার্ড কিং। বেশ কিছুদিন ব্রেজিলে অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ জীবন কাটিয়ে সে সম্প্রতি দেশে ফিরে দিব্যি গুছিয়ে বসেছে। তার উপার্জনের পন্থাটা কী সেটা আমার জানা নেই, তবে তার। অবস্থা যে রীতিমতো সচ্ছল সেটা বোঝা যায়ই, কারণ সে এখন সাফোকের ক্লিণ্টন-অন-দ্য-মার্শে গ্রেল্যান্ডসের জমিদারির মালিক। ইংল্যান্ডে আসার পর প্রথম বছরটা সে আমার কঞ্জুস জ্যাঠার মতোই আমার কোনও খোঁজখবর নেয়নি, কিন্তু এক গ্রীষ্মের সকালে মনটা খুশিতে ভরে উঠল, যখন দেখলাম, সে একটি চিঠি মারফত গ্রেল্যান্ডস কোর্টে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসার জন্য আমায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমি তখন দেউলে হবার আশঙ্কায় অন্যরকম কোর্টে যাবার কথা ভাবছিলাম, আর ঠিক সেই সময় দৈবক্রমে এসে গেল এই চিঠি। আমার এই অচেনা ভাইটিকে যদি হাত করতে পারি, তা হলে হয়তো একটা উদ্ধারের পথ পেলেও পেতে পারি। অন্তত বংশমর্যাদার খাতিরেও তো তার আমাকে পথে বসতে দেওয়া উচিত নয়। চাকরকে বলে আমার বাক্স গুছিয়ে নিয়ে সেইদিনই সন্ধ্যায় আমি ক্লিপটন-অন-দ্য-মার্শের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম।