সেই রাত্রে মিউজিয়মে গিয়ে আমি প্রথম সারির চারটে নকল পাথর খুলে ফেলে আসল পাথর বসিয়ে দিলাম। কাজটা সহজ নয়, এবং সেটা করতে আমার সারারাত লেগে গেল। সিম্পসনের পায়ের শব্দ পেলেই আমি মমি-কেসের মধ্যে লুকিয়ে পড়তাম। স্বর্ণকারের কাজ সম্বন্ধে আমার কিছু জ্ঞান আছে, কিন্তু উইলসন ছিল আমার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ। সে যেভাবে মেকি পাথরগুলো বসিয়েছিল, তাতে সোনার কারুকার্য একটুও রদবদল হয়নি। কিন্তু আমার ছিল কাঁচা এবং বুড়ো হাতের কাজ। আমি চাইছিলাম যে যে-কদিন আমি কাজটা করব, সেকদিন যেন কেউ বেশি মনোযোগ দিয়ে কবচটাকে না দেখে। যাই হোক, একইভাবে দ্বিতীয় রাত্রে দ্বিতীয় সারির পাথরগুলো বসিয়ে ফেললাম। আজ কাজটা শেষ হয়ে যেত, কিন্তু অদৃষ্টের ফেরে সেটা হল না, এবং সেইসঙ্গে আমাকে এমন সব কথা বলে ফেলতে হল, যেগুলো একান্তই গোপনীয়। এখন আপনারা নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে স্থির করুন, এখানেই ঘটনার পরিসমাপ্তি হবে, না এটাকে আরও কিছুদূর টেনে নেবেন। আমার নিজের শান্তি, আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ এবং তার ভাবী পতির সংস্কার–সবই নির্ভর করছে আপনাদের সিদ্ধান্তের উপর।
মর্টিমার বলল, সিদ্ধান্ত হল এই যে, যেহেতু সব ভাল যার শেষ ভাল, এই মুহূর্তে সমস্ত ঘটনাটির উপর চিরকালের মতো যবনিকা ফেলে দেওয়া হোক। কালই একজন পাকা স্বর্ণকারকে দিয়ে পাথরগুলো ঠিক করে বসিয়ে কবচটাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। এবারে আপনার হাতটা দিন, প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস, আর আশীবাদ করুন যেন এরকম অবস্থায় যদি কোনওদিন পড়তে হয় আমাকে, আমিও যেন আপনার মতো নিঃস্বার্থ আচরণ করতে পারি।
কাহিনী শেষ করার আগে একটা কথা বলা দরকার। এক মাসের মধ্যেই এলিজের বিয়ে হয়ে গেল তার সঙ্গে যার আসল নামটা বললে পাঠক বুঝতে পারতেন যে, তিনি এখন সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। কিন্তু সত্যি কথাটা হল এই যে, সম্মান তার চেয়েও বেশি প্রাপ্য সেই শান্তস্বভাবা তরুণীর, যিনি তাঁর স্বামীকে পাপের পঙ্কিল পথ থেকে উদ্ধার করে ভদ্রসমাজে তার স্থান করে দিয়েছিলেন।
দি জু’স ব্রেস্টপ্লেট
সন্দেশ, অগ্রহায়ণ, পৌষ ১৩৯১
ঈশ্বরের ন লক্ষ কোটি নাম
আপনাদের অর্ডারটা একটু অস্বাভাবিক ধরনের, বিস্ময়ের মাত্রাটা যথাসম্ভব কমিয়ে বললেন ডাঃ ওয়াগনার–আমি যতদূর জানি, এর আগে কোনও তিব্বতি গুম্ফা থেকে অটোমেটিক সিকুয়েন্স কম্পিউটারের জন্য অর্ডার আসেনি। আপনাদের ঠিক এই ধরনের মেশিনের প্রয়োজন হতে পারে সেটা আমি ভাবিনি। আপনারা কী কাজের জন্য যন্ত্রটা চাইছেন, সেটা একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?
নিশ্চয়ই, তাঁর সিল্কের আলখাল্লাটিকে সামলে নিয়ে, স্লাইড রুলের সাহায্যে ডলার ও তিব্বতি মুদ্রার পারস্পরিক সম্পর্কের হিসাবটা স্থগিত রেখে বললেন লামা। নিশ্চয়ই বলব। আপনাদের মার্ক-৪ কম্পিউটার সবরকম গণনারই কাজ করতে পারে, যদি না একসঙ্গে দশটার বেশি সংখ্যার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের কাজের জন্য আমরা সংখ্যার কথা ভাবছি না–আমরা ভাবছি অক্ষরের কথা। আপনারা যদি যন্ত্রের সার্কিটে কিছু অদল-বদল করে সেটাকে এমন একটা অবস্থায় এনে দিতে পারেন, যাতে তার সাহায্যে সংখ্যার বদলে অক্ষর ছাপা হবে, তা হলেই আমাদের কাজ হয়ে যায়।
ব্যাপারটা কিন্তু আমার কাছে এখনও ঠিক—
আমরা এই কাজটা বিনা যন্ত্রে গত তিনশো বছর ধরে করে আসছি। অর্থাৎ আমাদের গুম্ফা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকে। হয়তো কাজটা আপনি এখনও ঠিক অনুধাবন করতে পারছেন না, কিন্তু যদি একটু মন দিয়ে শোনেন, তা হলেই পারবেন।
বেশ তো।
আসলে ব্যাপারটা খুবই সহজ। আমরা একটা তালিকা প্রস্তুত করছি, যাতে ঈশ্বরের যতরকম নাম হয়, তার সবগুলিই থাকবে।
মানে–?
লামা নিরুদ্বিগ্নভাবে বলে চললেন, আমাদের বিশ্বাস, ঈশ্বরের কোনও নাম লিখতেই নটির বেশি অক্ষরের প্রয়োজন হয় না। অবিশ্যি, নাম লিখতে যে বর্ণমালা ব্যবহার হবে, সেটা নতুন এবং আমাদেরই তৈরি।
এই কাজ আপনারা তিনশো বছর ধরে করছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা অনুমান করি, কাজটা সম্পূর্ণ হতে লাগত আরও পনেরো হাজার বছর।
ডাঃ ওয়াগনার এখনও খেই পাচ্ছেন না। তিনি বললেন, বুঝলাম। এখন বুঝতে পারছি, কেন আপনারা কম্পিউটার ব্যবহার করার কথা ভাবছেন। কিন্তু এই কাজের আসল উদ্দেশ্যটা কী?
লামার মধ্যে যেন কিঞ্চিৎ ইতস্তত ভাব। ডাঃ ওয়াগনারের আশঙ্কা হল, তিনি বুঝি অজান্তে অপমানসূচক কিছু বলে ফেলেছেন। কিন্তু লামার উত্তরে কোনও বিরক্তি প্রকাশ পেল না।
এই কাজটা আমাদের আচারানুষ্ঠানের একটা অঙ্গ। আমরা এটাকে একটা কর্তব্য বলে মনে করি। যতরকম নামে মানুষ ঈশ্বরকে জানে–গড়, জেহোভা, আল্লা, ইত্যাদি–এগুলো সবই মানুষের দেওয়া নাম। এখানে অবিশ্যি কতগুলো দার্শনিক প্রশ্ন এসে পড়ছে যেগুলো আমি আলোচনা করতে চাই না, কিন্তু নটি অক্ষরে সীমাবদ্ধ রেখে যদি আমরা সেগুলিকে পারমিউটেশন কম্বিনেশনের সাহায্যে পাশাপাশি বসিয়ে চলি, তা হলে আমার বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত আমরা ঈশ্বরের সবকটি নামই লিখে ফেলতে পারব। সেই বিন্যাসের কাজটা আমরা এতদিন যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই করে আসছি।
বুঝেছি–আপনারা AAAAAAAA থেকে শুরু করে ZZZZZZZZZ পর্যন্ত যেতে চান।