ছেলেটির বুকের পাটা যে অসামান্য, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আমার কথা সে শেষ পর্যন্ত শুনে কোনও বিস্ময় বা বিরুদ্ধভাব প্রকাশ না করে ঘরের উলটোদিকে গিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে চাকরকে ডেকে পাঠাল। চাকর এলে পর তাকে বলল, মিস্ অ্যাড্রিয়াসকে গিয়ে বলো, তিনি যেন অনুগ্রহ করে এখানে আসেন।
আমার মেয়ে এল। উইলসন এগিয়ে গিয়ে তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, এলিজ, তোমার বাবা এইমাত্র আবিষ্কার করেছেন যে, আমি একটি দুশ্চরিত্র ব্যক্তি–যেটা তুমি আগেই জানতে।
এলিজ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
উনি বলছেন যে আমাদের পরস্পরকে ত্যাগ করতে হবে, চিরকালের জন্য।
এলিজ কিন্তু এখনও তার হাত ছাড়িয়ে নেয়নি।
তোমার উপর কি আমি ভরসা রাখতে পারি, না কি একমাত্র যে আমাকে সৎপথে চালাতে পারে, সেও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?
জন! আমার মেয়ে গভীর আবেগের সঙ্গে বলে উঠল, আমি কোনওদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না। দুনিয়ার সব লোক যদি তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তা হলেও না।
আমি আমার মেয়েকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনও ফল হল না। সে যেন এই যুবকটির সঙ্গে তার জীবন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। আমার মেয়ে আমার চোখের মণি; যখন দেখলাম যে তাকে সর্বনাশের হাত থেকে উদ্ধার করার কোনও উপায় নেই, তখন আমার যে কী অবস্থা হল তা বলতে পারি না। আমার অসহায় ভাব দেখে মনে হল উইলসনের কিছুটা দয়া হল। সে বলল, আপনি যতটা ভাবছেন, অবস্থা ততটা খারাপ নয়। এলিজের প্রতি আমার ভালবাসা এতই গভীর যে, হয়তো সেটাই আমাকে কলঙ্কের হাত থেকে উদ্ধার করবে। আমি কালই ওর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, জীবনে আর কখনও এমন কোনও কাজ করব না যাতে সে কষ্ট। পাবে। কথা দিয়ে কথা না রাখার লোক আমি নই।
উইলসনের কথায় মনে হল সে যা বলছে সেটা অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। কথাটা বলে সে পকেট থেকে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স বার করে বলল, আমি যা বলছি তা যে সত্যি তার প্রমাণ আমি দিতে চাই। এলিজ, আমার উপর তোমার প্রভাব যে মঙ্গলকর সেটা এবার বুঝতে পারবে। প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন যে আপনার সংগ্রহশালার অমূল্য সম্পদ আমাকে প্রলুব্ধ করেছিল। যে কাজে লাভের সম্ভাবনার সঙ্গে বিপদের আশঙ্কা জড়িয়ে থাকে, সে কাজের প্রতি চিরকালই আমি একটা আকর্ষণ বোধ করি, তাই ইহুদির কবচের পাথরগুলোকে হাত করার জন্য আমি বদ্ধপরিকর হই।
সেটা আমি অনুমান করেছিলাম।
কিন্তু একটা ব্যাপার আপনি অনুমান করতে পারেন নি।
কী?
যে সেগুলো হাত করতে আমি সক্ষম হয়েছিলাম। এই বাক্সের মধ্যে রয়েছে সেই পাথরগুলো।
এই বলে সে বাক্সটা খুলে আমার ডেস্কের উপর উপুড় করে ধরল। দৃশ্য দেখে আমার হাত-পা হিম হয়ে এল। সংকেত চিহ্ন আঁকা বারোটা মহামূল্য পাথর বেরিয়ে পড়েছে আমার টেবিলের উপর। এগুলোই যে উরিম ও ঘুমিমের পাথর, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সর্বনাশ! আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। তুমি ধরা না পড়ে এ কুকীর্তি করলে কী করে?
আসলের জায়গায় নকল পাথর বসিয়ে, বলল উইলসন, নকলগুলো এতই নিখুঁত যে, দুইয়ের মধ্যে তফাত করা অসম্ভব।
এখন যে পাথরগুলো কবচে লাগানো রয়েছে, সেগুলো নকল?
হ্যাঁ, এবং বেশ কিছুকাল আগেই ঘটেছে এই ঘটনা।
আমরা তিনজন কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মেয়ের মুখ বিবর্ণ হলেও সে তখনও তার হাত ছাড়িয়ে নেয়নি।
উইলসন এলিজের দিকে ফিরে বলল, আমার সাধ্যের মাত্রা কতদূর সেটা তো এবার বুঝলে?
এলিজ বলল, এটাও বুঝলাম যে দুষ্কর্ম করেছ, তার জন্য অনুতপ্ত হওয়াটাও তোমার অসাধ্য নয়।
সেটা তোমার প্রভাবের ফল বলল উইলসন, আমি পাথরগুলো আপনাকেই দিচ্ছি, প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস। আপনি এ ব্যাপারে যা করা উচিত মনে করবেন, তাই করবেন। কিন্তু মনে রাখবেন, আমার বিরুদ্ধে কিছু করা মানেই আপনার মেয়ের ভবিষ্যৎ স্বামীর বিরুদ্ধে করা। এলিজ, কিছুদিন পরেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব। এর পরে আর কোনওদিন আমার জন্য তোমাকে কষ্টভোগ করতে হবে না। এই বলে উইলসন প্রস্থান করল।
আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। অমূল্য পাথরগুলো এখন আমার হাতে, কিন্তু ধরা না পড়ে কী করে সেগুলো যথাস্থানে ফেরত দিই? এটা বুঝতে পারছি যে, আমার মেয়ে যে রকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাকে উইলসন-এর হাত থেকে কোনওমতেই রক্ষা করতে পারব না। আর উইলসনের প্রভাব যদি তার উপর সত্যিই মঙ্গলকর হয়, তা হলে তাকে রক্ষা করার প্রশ্নই বা আসবে কেন? উইলসনের মুখখাশ খুলে দিলেই বা কী ফল হবে, বিশেষ করে সে যখন আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে?
আমি অনেক ভেবে একটা রাস্তা বার করলাম, যেটা হয়তো আপনাদের কাছে খুব অবাচীন বলে মনে হবে, কিন্তু আমার মতে এ ছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না। আমি স্থির করলাম, কাউকে জানতে না দিয়ে আমি নিজেই গিয়ে পাথরগুলো যথাস্থানে বসিয়ে দেব। আমার চাবির সাহায্যে আমি যে কোনও সময় মিউজিয়মে ঢুকতে পারি, আর সিম্পসনের গতিবিধি যখন জানা আছে, তখন ধরা পড়ারও কোনও আশঙ্কা নেই। যা করতে যাচ্ছি সে সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলব না–আমার মেয়েকেও না–এটাও স্থির করলাম। মেয়েকে বললাম, আমি স্কটল্যান্ডে আমার ভাইয়ের কাছে। যাচ্ছি। কটা রাত কারুর সন্দেহ উদ্রেক না করে আমি নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারি, এটাই ছিল আমার লক্ষ্য। সেই রাত্রেই হার্ডিং স্ট্রিটে একটা ঘর ভাড়া করলাম। বাড়িওয়ালাকে বললাম আমি খবরের কাগজে কাজ করি, আমাকে রাত্রেও কাজে বাইরে যেতে হতে পারে।