–তা তো বটেই। ফ্রান্সিস হেসে বলল–আবার আপনারাও কেই পাবেন না। এত স্বর্ণসম্পদ দেখে ইবু গ্যাব্রিয়েল সম্পদের অংশ যে দাবি করবে সেই মরবে।
–এই সিন্দুক আমরা আমাদের নৌকায় তুলে নিয়ে যাবো। বেশ গম্ভীর গলায় রব্বানি বলল। –বেশ। আপনারা খুশি হলে আমরাও খুশি। রব্বানি গলা চড়িয়ে বলল–অ্যাই–হাতলাগা। এই সিন্দুক আমাদের নৌকায় তোল।
উল্লাসে যোদ্ধা কজন এক লাফে এসে। সিন্দুকটা ধরল। তারপর আস্তে আস্তে কাঁধে তুলে ওদের নৌকোর দিকে চলল। উৎসাহের চোটে রব্বানিও নিজের পদমর্যাদা ভুলে গিয়ে কাঁধ লাগল।
–চলো হ্যারি ওপারে যাই। আমাদের কাজ শেষ। ফ্রান্সিস ওদের নৌকা যেখানে ভেড়ানো রয়েছে সেদিকে চলল। সিনাত্রা শাঙ্কো এগিয়ে এল। এত ভেবে চিন্তে এত কষ্ট করে ওরা এই সম্পদ তুলল সেটা ওদের চোখের সামনে দিয়ে বিন্দুমাত্র পরিশ্রম না করে রব্বানিরা নিয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস ওদের মুখ দেখেই বুঝল ওরা কি বলতে চায়। সেটাকে আমলে না দিয়ে ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো–যে বাড়তি কাছি দড়ি পড়ে আছে সে সব নিয়ে এসো। এবার নৌকোয় চড়েই ওপারে যাবো। ওসব কখন কি কাজে লাগে। যাও। শাঙ্কো আর সিনাত্রা গিয়ে কাটা কাছি দড়ি নিয়ে এল।
–নৌকায় চলো বিকেল হয়ে এসেছে। কাল রাতে আমাদের কারও ভালো ঘুম হয় নি। ভীষণ ক্লান্ত আমরা। ফ্রান্সিস বলল।
সবাই নৌকোর দিকে চলল। যেতে যেতে এবার হ্যারি বলল–এত স্বর্ণমুদ্রা ঐ পিতৃহন্তাকে দিয়ে দেবে ফ্রান্সিস?
–কী করবে বলল হ্যারি? এই ভাণ্ডার নিয়ে না গেলে আমাদের জীবন বিপন্ন হবে। রব্বানি আমাদের সহজে পালাতে দেবে না। পিছু ধাওয়া করবে। এত স্বর্ণসম্পদ দেখে ওরা ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো আমাদের পিছু নেবে। ধরা পড়বই। ভুলে যেওনা ওরা সশস্ত্র। আমাদের অস্ত্র একমাত্র শাঙ্কোর ছোরা। এমনি ওদের মানিয়ে চললে আমরা প্রাণে রক্ষা পাবো। কিন্তু পালাতে গিয়ে ধরা পড়তেই হবে। রব্বানি ঠিক আমাদের হত্যা করবে। আর একটা কথাও তো মানতে হবে। মারিয়া আর বন্দী বন্ধুদের কী অবস্থা হবে তা এই নরপশুর হাতে। হ্যারি হাঁটতে হাঁটতে ভাবল সত্যি এছাড়া কোন উপায় নেই। ভেবে দেখ–আমরা তো এই স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করতে আসি নি। স্বর্ণভাণ্ডার তো একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে ইবু গ্যাব্রিয়েলরই। ওরই তো অধিকার এই সম্পদে। আমাদের তো এই সম্পদের ওপর কোন অধিকারই নেই।
নৌকোয় চড়ে সবাই ওপরে এল। সব ভাইকিং বন্ধুরা নিঃশব্দে নৌকোয় উঠল। সিন্দুক নিয়ে সামনে রইল রব্বানির নৌকা। আজ শেষ বিকেল। নৌকোগুলো চলল ইতেরাস গ্রামের দিকে।
ইরেকাবা গ্রামের ঘাটে গিয়ে সব নৌকো ভিড়ল। সেই সকালে আধপেটা খেয়ে গিয়েছিল। এখন ক্ষুধাতৃষ্ণায় সবাই কাতর ভীষণ ক্লান্তও। সিন্দুকটা রব্বানি দুজন যোদ্ধার জিম্মায় রেখে গ্রামের দিকে চলল। গ্রামে ঢুকে ক্লান্তিতে ফ্রান্সিসও শুয়ে পড়ল। পাশে বসা হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস এখন কী করবে?
এখন বিশ্রাম অবশ্য প্রয়োজন। রাতের খাওয়া সেরেই নৌকো ভাসিয়ে দেব। ফ্রান্সিস ক্লান্ত স্বরে বলল।
–কিন্তু রব্বানিরা যদি রাতটা এখানেই থাকতে চায়।
-থাকবে। আমরা কোনমতেই থাকবো না। একটা কাজ কর-বৃদ্ধকে দুটো স্বর্ণমুদ্রা দাও আর বলল যে বেশি করে যেন রুটি তৈরি করে। সবাই ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত। পেট পুরে খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেই বেশ তরতাজা হয়ে যাবো। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি চলে গেল বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলতে। একটু রাত হতেই সবাই শুনো পাতা উঠনে পেতে খেতে বসল। যথেষ্ট রুটি করা হয়েছে। মাছের তো অভাবই নেই।
খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–সবাই কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নাও। তারপর আমরা নৌকা ভাসাবো। এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবো না। রব্বানি এসে হ্যারিকে বলল–আমরাও আপনাদের সঙ্গে একসঙ্গে ফিরবো বেশ। চলুন। হারি বলল।
নৌকাগুলো ছেড়ে দেওয়া হল। আজ আকাশ–জ্যোৎস্না উজ্জ্বল। ফ্রান্সিসের ক্লান্তি অনেকটা কেটেছে। ও নৌকায় গুটিয়ে শুয়ে রইল। তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। এই একই আকাশ তো ওদের দেশেও। তবে ওদের দেশের আকাশের জ্যোত্সা এত উজ্জ্বল হয়। শীতের দেশ। কিন্তু এই চিন্তার মধ্যে একটা চিন্তা কিছুতেই ওর পিছু ছাড়ছিল না। বেশ কষ্ট করেই তো স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার হল। এই পরিশ্রম ও বিশেষ গায়ে মাখে না। কিন্তু চিন্তাটা হ’ল ইবু গ্যাব্রিয়েল তো স্বর্ণভাণ্ডার পেলেই ওদের সম্বন্ধে আর কোন আগ্রহই থাকবে না। ঐ লোকটাকে বিশ্বাস নেই। বহু আকাঙিক্ষত স্বর্ণভাণ্ডার পেলে ওর মতো লোভী নীচ মানুষ কী চেহারা ধরবে সেটা ভেবেই ফ্রান্সিসের মন ভীষণ উদ্বেগকাতর হল। পাশেই বসেছিল হ্যারি। ও তো ভালো করেই চেনে ফ্রান্সিসকে। সহজেই বুঝে নিল–ফ্রান্সিস জেগে আছে বটে কিন্তু গভীরভাবে কিছু ভাবছে। তাই ডাকল– ফ্রান্সিস?
–হুঁ।
–নিশ্চয়ই খুব চিন্তায় পড়েছ।
–স্বাভাবিক। স্বর্ণভাণ্ডার পেয়ে যদি ইবু গ্যাব্রিয়েল আমাদের শর্ত অস্বীকার করে।
–অসম্ভব নয়। তবে এতদিন ধরে যে গোপন স্বর্ণভাণ্ডারের চিন্তায় উদ্ধার করে নিজের হাতে পাবার জন্যে চেষ্টা করেছে নিজের পিতাকে হত্যা করেছে তা পেয়ে হয়তো লোকটা উদার হয়ত হতেই পারে। হয়তো আমরা বাঁচলাম কি মরলাম তাই নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাববে না। হয়তো আমরা আজ ওর কাছে বাতিল হয়ে যাবো।