লোহার গেটের সামনে বুলেট পৌঁছতেই স্টিল প্লেটের গায়ে একটা খুপরি খুলে একজন তাকিয়েছিল। তারপরেই খুলে গেল গেট, ঢুকে গেল বাইক।
ট্যাক্সি ছাড়লাম না। পানের দোকানে বসে গল্প শুরু করলাম। এ বাড়ির মালিকের নাম দয়ালশঙ্কর শেঠ। মারোয়াড়ি নয়। বাঙালি শেঠ। বহু বছর আগে এই বাড়ি আর বাগান কিনে নিয়েছে। আগের মালিক রেস খেলেই ফতুর হয়েছিল। এখনকার মালিক বাড়ি থেকেই বেরোয় না। একটা বিরাট গাড়ি আছে। বিলিতি গাড়ি। কালেভদ্রে তাতে চেপে এদিক-ওদিক ঘুরে আসে। ছেলেপুলে নেই। বউ বড় খিটখিটে। চাকর-দারোয়ান মালি-ঝি আউটহাউসে থাকে। উলটোদিকের পাঁচিলের ধারের দোতলা বাড়িটায় থাকে লিকলিকে একটা লোক খুব বদমেজাজি। কারও সঙ্গে মেশে না। নিজের বাড়ির চারদিকে জঙ্গল বানিয়ে রেখেছে। মালিকে ঘেঁষতে দেয় না। গভীর রাতে সেখানে হাসি আর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। কখনও মেয়েছেলের কখনও ব্যাটাছেলের। লোকটার চরিত্র ভালো নয়। জ্যান্ত পিশাচ। মুখ দেখলেই বোঝা যায়।
ঠিক এই সময়ে বুলেট-এর বিকট আওয়াজ শুনলাম। হেলমেটধারী বাচ্চু বেরিয়ে এল দু চাকায় চেপে। ট্যাক্সির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে চেয়ে দেখল সেদিকে। ভাগ্যিস আমি দূরে পানের দোকানে বসেছিলাম আমাকে দেখবার আগেই উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম দোকানের পেছনে। বুলেট বেরিয়ে গেল সামনে দিয়ে। ট্যাক্সি নিয়ে পেছন-পেছন আমি ফিরে এলাম মুচিপাড়ায়।
কমলা বসেছিল আমার জন্যে। সব শুনল। বললে, বুনো হাঁসের পেছনে আর কদ্দিন দৌড়োব, সত্য?
আমি বললাম, কী করতে চাও?
ও বললে, বিয়ে।
আমাকে?
হ্যাঁ।
কিন্তু আমি সত্যিই পাগল ছিলাম কি না, সেটা না জেনে তো বিয়ে করব না।
সেটা জানবার ভার দাও যোগ্য লোককে। ছমাসেও আমরা যা পারিনি–ছদিনে তা জানা যেতে পারে।
গোয়েন্দার কথা বলছ?
হ্যাঁ। ইন্দ্রনাথ রুদ্র তার নাম।
.
ইন্দ্র বললে, এখান থেকে মুচিপাড়া বেশি দূরে নয়। আপনি কমলাকে নিয়ে আসুন।
সত্য বললে, সে সুভাষ সরোবরে বসে আছে। আপনার বাড়ির সামনেই।
নিয়ে আসুন।
মিনিট কয়েক পরেই কমলাকে নিয়ে ফিরে এল সত্য। একবিন্দুও রং চড়ায়নি সে কমলার চেহারার বর্ণনায়। সত্যিই চাবুক চেহারা। তীব্র চাহনি। সালোয়ার কামিজের আড়ালে বাঁকা ভোজালিই বটে।
হাত তুলে সে বললে ইন্দ্রকে, আমি আপনার গুণমুগ্ধ।
বেগুন মুগ্ধ, বলে হাল্কা হেসে দুজনকে সোফায় বসাল ইন্দ্র। কোনও বাগাড়ম্বর করল না। কমলাকে বললে, সত্য বসুর উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট। আপনারটা নয়।
আমার উদ্দেশ্য?
হ্যাঁ।
খুব সোজা।
না। খুব বেঁকা।
মানে? আপনি জানতে চান, আপনার বাবা অত টাকা কোত্থেকে পেয়েছিলেন?
যেন অদৃশ্য চাবুকের আঘাতে বিবর্ণ হয়ে গেল কমলা।
ইন্দ্র বললে, কত টাকা ছিল জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে?
পাঁচ লাখ।
পুরুলিয়ায় একজন ছাপোষা ডাক্তার এত টাকা হঠাৎ পেল কোত্থেকে? এইটাই আপনার কৌতূহল। পাপের টাকার সুদে মা-মেয়ের এতদিন চলছে কি না–এইটাই আপনি জানতে চান।
হ্যাঁ।
পুরো ব্যাপারটায় টাকার খেলা চলছে। টাকার খুব গন্ধ পাচ্ছি। দেখা যাক কী করতে পারি।
পরপর কয়েকটা ফোন করে গেল ইন্দ্রনাথ।
প্রথম ফোনটা ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের এক চাই অফিসারকে। একশ নম্বর সার্পেন্টইন লেনের বাচ্চু সেন কত বছর আগে জমি কিনেছিলেন? বাড়ি কি কনট্রাক্টর তৈরি করেছিল? কত টাকা লেগেছিল। আন্দাজি হিসেব পেলেই চলবে। অসম্ভব? অসম্ভবকে সম্ভব করাই কর্পোরেশনের কাজ। টাকায় সব হয়। খবর নিতে হবে বাচ্চু সেনকে না জানিয়ে।
দ্বিতীয় ফোনটা চব্বিশ পরগণার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে। তিনি তরুণ আই এ এস অফিসার। ইন্দ্রনাথ তাকে দাবড়ি দিয়ে বলে গেল, দয়ালশঙ্কর শেষ কত বছর আগে জায়গা জমি কিনেছিলেন? কার কাছ থেকে কত টাকায় কিনেছিলেন? আগে কোথায় থাকতেন? এ খবরও নিতে হবে দয়ালশঙ্করকে না জানিয়ে।
তৃতীয় ফোনটা দিল্লির প্রেমচাঁদ ডিটেকটিভ এজেন্সিকে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রেমচাঁদ মালহোত্রা ইন্দ্রনাথকে তোয়াজ করতে পারলে যেন বাঁচে। ইন্দ্রনাথ তাকে তুই তোকারি করে বলে গেল, আজ থেকে আটাশ বছর আগে একটা বার্থ সার্টিফিকেট দিল্লি থেকে ইস্যু করা হয়েছিল। সুপ্রিয় আর সাধনা বসু ছেলে সত্য বসুর নামে এই সার্টিফিকেট নিয়েছিল। বাবা আর মায়ের বর্তমান ঠিকানা বের করা যাবে?
.
সাত দিন পরে। সন্ধে হয়েছে। দয়ালশঙ্কর শেঠ-এর বাড়ির একতলায় বিশাল বসবার ঘরে ঢুকলেন ডি এম কালিপ্রসাদ সিংহ। সঙ্গে রয়েছে ইন্দ্রনাথ।
কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকলেন দয়ালশঙ্কর শেঠ, বয়স প্রায় ষাট। ধবধবে সাদা গায়ের রং। দীর্ঘ, সৌম্য আকৃতি। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। গায়ে কেমব্রিকের পাঞ্জাবি। ফরসা রং ফুটে বেরোচ্ছে কেমব্রিক যুঁড়ে।
রাগে কাঁপছেন দয়ালশঙ্কর। বললেন, এ সব কী হচ্ছে এ বাড়িতে? সার্চ ওয়ারেন্ট আছে আপনার?
এস পি এসে সেটা দেখাবেন। উনি এখন আপনার ডান হাতকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন। বললেন মিঃ সিংহ।
আমার ডান হাত?
বসুন বসুন, দাঁড়িয়ে কি কথা হয়? অনেক কথা আছে। হ্যাঁ আপনার ডান হাত–সচ্চিদানন্দ ঘোড়ই। তার জঙ্গলঘেরা বাড়িতে এখন সার্চ চলছে। অন্ধ ভিখিরি সাধুচরণকে ট্রেস করা হচ্ছে। চিনতে পেরেছেন তাহলে? সাধুচরণ! মেট্রো রেলের পাতাল কুপে পড়ে যে মারা গেছে।