কল্যাণানন্দ মোটেই বিচলিত না হয়ে বললেন, “ছেলেটি আমাকে সব কথা বলেছে। সব অন্যায় স্বীকার করতে করতে সে কেঁদে ফেলেছে এবং আমাকে কথা দিয়েছে, এখানে আমি ভালো হবার চেষ্টা করব, আপনি যা বলবেন আমি তাই শুনব। আমি খুব সাবধানে থাকব।”
এরপর গলাটা একটু উঁচু করে মঠের ভাবী সভাপতিকে বিবেকানন্দশিষ্য বললেন, “সোনা থেকে সোনা করবার জন্যে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মর্তধামে আসেননি। তিনি নিম্নস্তরের ধাতুকে সোনা করে দিতে পারতেন। আমরা যদি এই ধরনের ছেলেকে পাল্টে দিতে পারি তা হলে সেটাই আমাদের সেরা কাজ হবে। তুমি কি শুধু ভাল ছেলে চাইছ? তারা তো ভালো হয়ে আছে!”
পরবর্তী সময়ে এই ছেলেটির মধ্যে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন এসেছিল। এখানে আসবার আগে ভীষণ মেজাজ ছিল, রাগে অন্ধ হয়ে জিনিসপত্তর একবার নয় তিনবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু কনখলে সে সত্যিই নতুনভাবে জীবন আরম্ভ করল।
.
স্বামী কল্যাণানন্দের মর্মস্পর্শী মহাসমাধির বর্ণনা তাঁর অনুগতের চোখ দিয়ে (২০শে অক্টোবর ১৯৩৭) আমরা এই নিবন্ধের শেষ অংশে দেখব। কিন্তু তার আগে আজব স্বামীজির আরও একজন আজব অনুরাগী চারুচন্দ্র দাস (পরে স্বামী শুভানন্দ) এবং তার প্রাণপ্রিয় বারাণসী সেবাশ্রমের কিছু কথা বলে নেওয়া যেতে পারে।
অন্য অনেক তথ্যসূত্রের সঙ্গে এই পর্বের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় স্বামী নরোত্তমানন্দের ‘সেবা’ বইতে। বইটির বাংলা অনুবাদ হাতের গোড়ায় ছিল না, ফলে নির্ভর করেছি ইংরিজিতে প্রকাশিত একই নামের বইয়ের ওপরে।
প্রাক সন্ন্যাসজীবনে বিবেকানন্দশিষ্য স্বামী শুদ্ধানন্দ একবার কলকাতায় চারুচন্দ্রের পাঁচু খানসামা লেনের বাড়িতে এসেছিলেন,সঙ্গী ছিলেন জনৈক ক্ষিরোদবাবু। বারাণসীতে আবার দেখা হয়ে গেল শুদ্ধানন্দর সঙ্গে–এইখানে শুদ্ধানন্দ অসুস্থ হয়ে পড়ায় কিছুদিন সেবাযত্নের সুযোগ পেয়ে যান চারুচন্দ্র। শুদ্ধানন্দ তাকে সদ্যপ্রকাশিত উদ্বোধন পত্রিকার কথা বলেন এবং এই পত্রিকার প্রচারের অনুরোধ জানান। এই প্রচারে বেরিয়েই হরিনাথ ও কেদারনাথ মৌলিক (পরে স্বামী অচলানন্দের) সঙ্গে চারুচন্দ্রের জানাশোনা হয়। একসময়ে স্বামী কল্যাণানন্দ বারাণসীতে এসে কেদারনাথের অতিথি হন। এঁদের আলোচনার প্রধান বিষয় স্বামী বিবেকানন্দ, জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের সমন্বয়ের যে সাধনা রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে শুরু হয়েছে তা এঁদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করল।
কেদারনাথ মৌলিক এই সময় সংসার ত্যাগ করতে ব্যাকুল। চারুচন্দ্র দাস পরামর্শ দিলেন ঠাকুরের শিষ্য নিরঞ্জনানন্দ এখন হরিদ্বারে রয়েছে, ওখানে যাও। কেদারনাথ বললেন দাদু এবং বাবা বুঝতে পারলে আমাকে ছাড়বেন না। তখন মতলব হলো, কেদারনাথ কতকগুলো পোস্টকার্ড লিখে দিয়ে যাবেন, সেগুলো মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে ডাকে দেওয়া হবে, যাতে মনে হয় কাজকর্মের সন্ধানে কেদারনাথ কলকাতায় রয়েছেন।
বিবেকানন্দ-অনুরাগী যে কয়েকজন বন্ধু মিলে বারাণসীতে সেবা কার্য আরম্ভ করেছিলেন তাদের একজনের নাম যামিনীরঞ্জন মজুমদার। উদ্বোধন পত্রিকায় স্বামীজির কবিতা সখার প্রতি পড়েই তারা উদ্বুদ্ধ।
যামিনীরঞ্জন প্রত্যুষে বাঙালীটোলার মধ্য দিয়ে গঙ্গাস্নানে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ চমকে শুনলেন–কার যেন অস্ফুট কাতরধ্বনি! অন্য সময় হলে হয়ত পুণ্যার্থীদের ধর্মধ্বনি ঐ কাতর শব্দটুকুকে আচ্ছন্ন রাখত–কিন্তু গত রাত্রে যে যামিনীরঞ্জন নবধর্মমন্ত্র লাভ করেছেন! সুতরাং তিনি চোখ চেয়ে দেখলেন–পথের পাশে আবর্জনার মধ্যে পড়ে রয়েছে মুমূর্ষ এক বৃদ্ধা, মলমূত্রে সর্বাঙ্গ পূর্ণ।
স্বামীজির কবিতা পাঠ করে উদ্বুদ্ধ যামিনীরঞ্জন বৃদ্ধার গা পরিষ্কার করে, নিজের উত্তরীয় দিয়ে তাঁকে ঢেকে, পথের ধারে কোলে তুলে নিয়ে বসলেন, এবং তার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে ভাবতে লাগলেন–এখনি যদি এঁকে আশ্রয়, ঔষধ ও পথ্য দেওয়া না যায় তাহলে মৃত্যু সুনিশ্চিত। কিন্তু যামিনীরঞ্জন নিজে ভিক্ষাজীবী, এখন কপর্দকশূন্য, কী করবেন?
অগত্যা বৃদ্ধাকে এক বাড়ির রকে শুইয়ে ভিক্ষার সন্ধানে বেরুলেন। এক সহৃদয় ব্যক্তির অনুগ্রহে চার আনা পয়সা পেলেন তা দিয়ে দুধ কিনে এনে বৃদ্ধাকে খাওয়ালেন, তারপর বৃদ্ধা কিছু সুস্থবোধ করলে পুঁটিয়ারাণীর ছত্রে গেলেন বৃদ্ধার জন্য অন্নভিক্ষা করতে। এই ছত্রের অন্নেই যামিনীরঞ্জনের উদরপূর্তি হত–সেই বরাদ্দ অন্নই তিনি চাইলেন, নিয়ে যাবেন বলে। ছত্রের নিয়ম সেখানে বসে খেতে হবে। বহু বাক্যব্যয়ের পরে যামিনীরঞ্জন বরাদ্দ অন্ন আদায় করে এনে বৃদ্ধাকে খাওয়ালেন, তাতে কিছু সুস্থ হয়ে বৃদ্ধা যে কাহিনি বললেন তা অতি ভয়াবহ, মানবিক নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।
বৃদ্ধা মাসাধিকাল আগে যশোহরের পল্লী-অঞ্চল থেকে কাশীবাস করতে এসেছেন ১০৮ টাকা সম্বল করে। এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর কঠিন রক্ত-আমাশয়ে পড়েন। বিনা চিকিৎসা ও বিনা পথ্যে যখন তাঁর মরণাপন্ন অবস্থা তখন ব্রাহ্মণ তাঁকে গঙ্গাতীরে ফেলে আসে। বৃদ্ধার জ্ঞান ছিল কিন্তু কথা বলার শক্তি ছিল না। ব্রাহ্মণটি প্রথমত, বৃদ্ধার অবশিষ্ট টাকাগুলি আত্মসাতের মতলবে ছিল। দ্বিতীয়ত, বুড়ি মরলে হয়ত পুলিশী হাঙ্গামা হতে পারে–তার হাঙ্গামাতে সে পড়তে চায়নি। বৃদ্ধা চারদিন গঙ্গাতীরে পড়েছিলেন, কেউ তাকে সাহায্য করেনি, বা ক্ষতিও করেনি। তারপরে নিরুপায়ে তিনি নিজেই কোনোক্রমে পথের মাটি-পাথর খাচে-খাচে হামাগুড়ি দিয়ে পূর্বোক্ত স্থানে এসে মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিলেন। জ্ঞান ফিরলে যেটুকু গোঙাতে পেরেছিলেন, তারই শব্দ যামিনীরঞ্জনকে আকৃষ্ট করেছিল।