সোনার সংসার পর্বের আর একটি টিপিক্যাল বাংলা দৃশ্য: দুটো তক্তপোষ জুড়ে ঢালা বিছানা, সেখানে শুয়ে আছেন প্রথমে বিলু, পরে মহেন্দ্র, ছোটবোন, দিদিমা ও মা। এই সময়ে পিতৃদেব বিশ্বনাথ বিদেশে এবং ছোটভাইয়ের জন্ম হয়নি।
মাতৃকুল বৈষ্ণব আর পিতৃকুল শাক্ত, তাই দুটো ভাবই বিশ্বনাথ পরিবারে প্রবাহিত হত। দিদিমার মা রাইমণি যখন বেঁচেছিলেন তখন শেষরাতে ঘুম ভাঙিয়ে তিনি কৃষ্ণকথা শোনাতেন। এঁদের পাল্লায় পড়ে, তুলসীগাছে জল না দিয়ে মহেন্দ্রনাথ কিছু খেতেন না। মুগের ডাল, পুঁইশাক, পেঁয়াজ হাঁড়িতে ছোঁয়ানো যেতো না। গোবর পর্যন্ত খেতে হতো। ভুবনেশ্বরীর পরিবারে এসময় বিদেশি ফুলকপিও অচল ছিল। এহেন ভাই, দাদা ও মা সেবার বাবার সঙ্গে রায়পুরে যাচ্ছে। মহেন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, “ঘোড়াতালাতে মাংস রান্না হল। আমি খাব না। দাদা মুখে মাংস গুঁজে দিয়ে পিঠে কিল মারতে লাগল, বলল খা। তারপর আর কি! বাঘ রক্তের আস্বাদ পেলে যা হয়।”– মায়ের দেওয়া শিক্ষাতেই বিবেকানন্দ চরিত্রের বুনিয়াদ গড়ে উঠেছিল। একবার ভুবনেশ্বরী তার বড় ছেলেকে বলেছিলেন, “ফল যা হোক না কেন, সর্বদা যা সত্য বলে মনে করবে তাই করে যাবে। অনেক সময় হয়তো। এর জন্য অন্যায় অপ্রীতিকর ফল সহ্য করতে হবে, তবু সত্য কখনো ছাড়বে না।” জননী নিজেই দুঃসাহসের পথে নিজের ছেলেকে ঠেলে দিতে পেরেছিলেন বলে আমরা যথাসময়ে বীরসন্ন্যাসীকে পেয়েছিলাম, সত্যের ব্যাপারে দর-কষাকষি করেননি বলেই যুগপুরুষের মর্যাদা লাভ করতে পেরেছিলেন ঘরছাড়া বিবেকানন্দ।
বিদেশে এক বক্তৃতায় বিবেকানন্দ বলেন, “জননীর নিঃস্বার্থপ্রেম ও পূতচরিত্র উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হওয়াতেই তিনি জীবনে যা কিছু সৎকার্য করিয়াছেন, সমস্তই সেই জননীর কৃপাপ্রভাবে।” আর একবার মায়ের অদ্ভুত আত্মসংযমের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আর কোন রমণীকে তিনি কখনও তার মায়ের মতন দীর্ঘকাল উপবাস করতে দেখেননি। তিনি নাকি একবার উপর্যুপরি চোদ্দ দিন উপবাস করেছিলেন।
সুখী সংসারের সভ্য হিসেবেই বিলু বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটে পরীক্ষা দিয়েছিল–এনট্রান্স, এফ এ এবং বি এ। পরীক্ষায় ফলাফল কিন্তু তেমন চিত্তাকর্ষক হয়নি। ইংরিজি ভাষায় যিনি আমেরিকা এবং ইংলন্ড জয় করবেন, তার ইংরিজিতে নম্বর এন্ট্রান্সে ৪৭, এফ এ তে ৪৬ এবং বি এতে ৫৬। এফ এ এবং বি এ তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ। অনেক চেষ্টায় বিবেকানন্দর মার্কশিট যাঁরা উদ্ধার করেছেন তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কৌতূহলীদের জন্য সোনার সংসারের সোনার ছেলের নম্বরগুলো লিপিবদ্ধ করা হল :
এনট্রান্স
ইংরিজি – ৪৭
দ্বিতীয় ল্যাংগোয়েজ – ৭৬
ইতিহাস – ৪৫
অঙ্ক – ৩৮
মোট – ২০৬
.
এফ এ
ইংরিজি – ৪৬
দ্বিতীয় ল্যাংগোয়েজ – ৩৬
ইতিহাস – ৫৬
অঙ্ক – ৪০
লজিক (৫০ নম্বর) – ১৭
সাইকোলজি (৫০ নম্বর) – ৩৪
মোট – ২২৯
.
বি এ
ইংরিজি – ৫৬
দ্বিতীয় ল্যাংগোয়েজ – ৪৩
অঙ্ক – ৬১
ইতিহাস – ৫৬
ফিলসফি – ৪৫
মোট – ২৬১
একালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক এবং তুলনাহীন বাংলা ও ইংরিজির লেখকের নম্বরের হাল দেখে আশাকরি আজকের কম নম্বর-পাওয়া ছাত্ররা কিছুটা ভরসা পাবেন। যা মনে রাখা প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভাল বা খারাপ নম্বরের সঙ্গে জীবনের পরীক্ষায় পাওয়া নম্বরের প্রায়ই কোনো সঙ্গতি থাকে না। আরও যা ভাববার বিষয়, আজও কেন আমাদের পরীক্ষাপদ্ধতি মানুষের যথার্থ গুণাবলীর মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয় না?
*
সোনার সংসারের সোনার ছেলে নরেন্দ্রনাথ প্রায়ই একই সময়ে দুটি প্রবল ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়েছিলেন। এক, আধ্যাত্মিক জগতের বিপুল আলোড়ন–দক্ষিণেশ্বরের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, দ্বিতীয়, পিতা বিশ্বনাথের আকস্মিক মৃত্যুতে পারিবারিক বিপর্যয়, এমন এক পরিস্থিতিতে যখন একুশ বছর বয়সের ওকালতি-পড়া জ্যেষ্ঠপুত্র ছাড়া কাছাকাছি আর কেউ উপার্জনক্ষম নেই।
বিরাট সংসারের বিরাট খরচ, কিন্তু উপার্জনের কোনো রকম পথ নেই; এবং সুযোগ বুঝে শরিকদের মামলা-মোকদ্দমা, যাতে বিধবা ভুবনেশ্বরী অসহায় ছেলেমেয়েদের হাত ধরে ভিটেমাটি ছাড়া হন।
একান্নবর্তী পরিবারের অভিশাপ যে কত নিষ্করুণ তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামীজির ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ জীবনসায়াহ্নে দুঃখ করেছেন, যাঁরা এই একান্নবর্তী পরিবার-প্রথার পবিত্রতা সম্বন্ধে গলাবাজি করে থাকেন তারা বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত নন। পারিবারিক কলহবিবাদ ও বিয়োগান্ত ঘটনাবলী তারা উপেক্ষা করে থাকেন। ভূপেন্দ্রনাথের মতে, “বর্তমান সমাজে এই প্রথা চালু রাখার স্বপক্ষে কোনো কারণই থাকতে পারে না।”
বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর কেউ তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে একটি কপদক দিয়েও সাহায্য করবার জন্যে এগিয়ে আসেননি। এই অপ্রিয় সত্যটুকু ভুবনেশ্বরীর কনিষ্ঠ সন্তান লিখিতভাবে জানিয়েছেন। “অথচ কলকাতাতেই আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন। কিন্তু বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর সকলেই যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সমাজ, আত্মীয়-স্বজন আমাদের কথা বিস্মৃত হলো…জীবন সংগ্রামের ক্ষেত্রে আমরা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম”, দুঃখ করেছেন ভূপেন্দ্রনাথ।
শেষ দিকে বিশ্বনাথবাবু তাঁর এটর্নি অফিসের ওপর তেমন নজর রাখতেন না। যে বন্ধুর ওপর তিনি কোম্পানির ভার অর্পণ করেন তিনি সুযোগ বুঝে বিশ্বনাথের নামে ঋণ করে সেইসব অর্থ আত্মসাৎ করতে থাকেন।