এই সময়ে রাখাল মহারাজ আমাকে একটু তফাতে লইয়া গিয়া হাতে দশটাকার একখানি নোট দিয়া বলিলেন : “তুমি নিবারণকে সঙ্গে নিয়ে গিরিশবাবুর নৌকায় ওপারে, বরানগরে গিয়ে বাজার থেকে কিছু সন্দেশ ও খাবার কিনে আনো। কাল রাত্তির থেকে সাধুরা কেউ মুখে জল দেয়নি–আর উপস্থিত ভক্তদেরও অনেকেরই খাওয়া হয়নি।”
মহারাজজীর আদেশমত কার্য করিতে আমাদের উভয়কে যাইতে দেখিয়া বরানগরনিবাসী ভক্ত বিপিন সাহা উহার উপর পাঁচ টাকা দিয়া আমাদের সঙ্গে ওপারে যাইয়া দোকানে গরম লুচি কচুরি সন্দেশ প্রভৃতি। তৈয়ারি করাইয়া ঝুড়ি নিজে বহিয়া আমাদের সঙ্গে পুনরায় মঠে ফিরিলেন। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে আমরা যখন মঠে পঁহুছিলাম, তখন চিতা নির্বাপণের পর স্বামীজির দেহাবশেষ সঞ্চয় করিয়া সন্ন্যাসিবৃন্দ এবং ভক্তগণ স্নানান্তে গঙ্গাসলিলে তৰ্পণ করিতেছিলেন।…
সমস্ত দিনের পর ঠাকুরের এই প্রথম সান্ধ্যজলপানি ভোগওআরতিহইয়া যাইলে নীচের তলার সমবেত সাধু এবং ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে চা, সরবৎ এবং প্রসাদ বিতরিত হইল। তাহার পরে গৃহীভক্তেরা একে একে ভগ্নহৃদয়ে বিদায় লইলেন।
স্বামীজির অন্তিম ইচ্ছা পূরণের জন্য ৪ জুলাই-এর (২০ আষাঢ়) পরবর্তী অমাবস্যার রজনীতে বেলুড় মঠে শ্ৰীশ্ৰীকালী পূজার অনুষ্ঠান হইয়াছিল। তাহাতে বাহিরের কাহাকেও আমন্ত্রিত করা হয় নাই। কেবল স্বামীজির কনিষ্ঠ সহোদর শ্রীভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় আসিয়াছিলেন।…
রাত্রি দশটার পর মঠের দোতলায় ঠাকুর-ঘরে শ্রীশ্রীকালীপূজা আরম্ভ হইলে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের পিতৃদেব প্রাচীন তান্ত্রিক সাধক ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয় পূজকের আসন গ্রহণ করিলেন। সাধু ও ব্রহ্মচারিগণ ঠাকুর প্রণাম করিয়া স্বামীজির ঘরে যাইয়া…বসিলেন। তাহার পূর্বে ঠাকুরের সন্ধ্যাকালীন ভোগ হইবার পরে পূজনীয় মহারাজজী স্বামী প্রেমানন্দ মহারাজকে বলিলেন : “ভূপেনকে আর এদের দুজনকে ঠাকুরের প্রসাদ খেতে দাও, আমাদের সকলের আজ উপবাস।”
প্রসাদ পাইবার পরে আমরা তিনজনে নীচেকার পশ্চিমদিকের বড় ঘরে শয়ন করিলাম, রাত্রিতে মধ্যে মধ্যে স্বামীজির বৃদ্ধ শিষ্য নিত্যানন্দ স্বামীর সকরুণ ক্রন্দন-ধ্বনিতে মঠ যেন মুখরিত হইয়া উঠিল।
রাত্রি ৩টার পরে শ্রীশরৎ মহারাজ নীচেকার ঘরে আসিয়া আমাদের তিনজনকে জাগাইয়া তুলিয়া উপরের..ঘরে যাইতে বলিলেন। সেখানে যাইলে মহারাজজী… আমাকে… আচমন করিয়া জপ করিতে বলিলেন। কিছুক্ষণ পরে মহারাজজীর আজ্ঞায় সকলে নীচের তলায় আসিয়া পশ্চিম দিকের দালানের সম্মুখস্থিত প্রাঙ্গণে বৃহৎ হোমকুণ্ডের চারিধারে বসিয়া জপ করিতে লাগিলেন।
হোমক্রিয়া সমাপনের পরে যে স্থানে স্বামীজির দেহে অগ্নি-সংস্কার করা হইয়াছিল সেইস্থানে সকলে যাইয়া সাতবার প্রদক্ষিণের পর প্রণত হইলেন এবং কিছুক্ষণ বেলতলায় বসিয়া জপ করিয়া ফিরিয়া আসিয়া ঠাকুর-ঘরে প্রণামের পর নীচে আসিয়া প্রসাদ গ্রহণ করিলেন।”
*
যে প্রশ্ন মাথায় রেখে স্বামীজিকে নিয়ে এই অনুসন্ধানের সূচনা করেছিলাম এবার সেখানেই ফিরতে হবে।
মহামানবদের জন্মদিন পালনে সনাতন ভারত সতত উৎসাহী, কিন্তু মৃত্যুদিনের স্মৃতিভার বহন তেমন প্রয়োজনীয় নয় কেন? স্বামী বিবেকানন্দর অন্ত্যলীলার অনুসন্ধান করতে গিয়ে তার উত্তর মিলে গিয়েছে। এই পৃথিবীতে অতি সাধারণ মানুষকে “মরিয়া প্রমাণ করিতে হয় সে মরে নাই।” মরার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয় অন্য সব মানুষের। কিন্তু মহামানবদের প্রকৃত বাঁচা শুরু হয় মৃত্যুদিন থেকে। সেই হিসেবে ৪ জুলাই ২০০২ মৃত্যুঞ্জয়ী বিবেকানন্দর প্রথম শতবর্ষপূর্তি।
ভগিনী নিবেদিতাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দর মধ্যে তফাত কী? নিবেদিতা উত্তর দিয়েছিলেন, অতীত পাঁচ হাজার বছরে ভারতবর্ষ যা কিছু ভেবেছে তারই প্রতীক শ্রীরামকৃষ্ণ, আর আগামী দেড় হাজার বছর ভারত যা কিছু ভাববে তারই অগ্রিম প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দ।
নিবেদিতার কথা যদি সত্য হয়, তা হলে স্বামী বিবেকানন্দর তিরোধান দিবস পালন সত্যই প্রয়োজনহীন।
মহাসমাধির দু’বছর আগে (এপ্রিল ১৯০০) স্বামীজি তাঁর অনুরাগিণী মার্কিনী বান্ধবী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে আশ্চর্য এক চিঠি লিখেছিলেন আলমোড়া থেকে।
আসন্ন বিদায়ের কথা মনে না থাকলে এমন চিঠি লেখা যায় কি না তা বিবেচনার ভার পাঠকের ওপরেই ছেড়ে দিতে চাই। কতবার যে স্বামীজির লেখা এই কটা লাইন পড়েছি তার হিসেব নেই, কিন্তু প্রতিবারেই বাণীটা নতুন মনে হয়। মনে হয় সমকালের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ অনন্তকালের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।
স্বামীজি লিখছেন : “আমি যে জন্মেছিলাম–তাতে খুশি; এতে যে কষ্ট পেয়েছি তাতেও খুশি; জীবনে যে বড় বড় ভুল করেছি–তাতেও খুশি। আবার এখন যে নির্বাণের শান্তি-সমুদ্রে ডুব দিতে যাচ্ছি–তাতেও খুশি। আমার জন্যে সংসারে ফিরতে হবে, এমন বন্ধনে আমি কাউকে ফেলে যাচ্ছি না; অথবা এমন বন্ধন আমি কারও থেকে নিয়ে যাচ্ছি না। দেহটা গিয়েই আমার মুক্তি হোক, অথবা দেহ থাকতে থাকতেই মুক্ত হই, সেই পুরনো ‘বিবেকানন্দ’কিন্তু চলে গেছে, চিরদিনের জন্য চলে গেছে–আর ফিরছেনা! শিক্ষাদাতা, গুরু, নেতা, আচার্য বিবেকানন্দ চলে গেছে পড়ে আছে কেবল সেই বালক, প্রভুর সেই চিরশিষ্য, চিরপদাশ্রিত দাস।”