তৎক্ষণাৎ আমরা তিনজন গৃহী ভক্ত এবং উক্ত নন্দলাল ব্রহ্মচারীজি স্বামীজির দেহখানি বহন করিয়া ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া আসিয়া নীচের দালানে পুষ্পসজ্জিত পালঙ্কের উপরে স্থাপন করিলাম। সেই সময়ে গোটাকতক বেদানা, আপেল, ন্যাসপাতি, আঙুর, স্বামীজির বক্ষের উপরে সাজাইয়া দেওয়া হইল। তখন বুড়ো গোপাল দাদা (স্বামী অদ্বৈতানন্দ) ব্রহ্মচারীজিকে বলিলেন : “ওরে নন্দলাল! আমাদের সকলের চেয়ে স্বামীজি তোকেই বেশি ভালোবাসিতেন। আজ তাঁর শেষ পূজা তোর হাতেই হোক।”
এই প্রস্তাব শ্রীমৎ রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) প্রমুখ সাধুবৃন্দ অনুমোদন করাতে, নন্দলাল স্বামীজিকে পুষ্পমাল্যাদি দানে এবং নানাবিধ ফল ও মিষ্টান্ন প্রভৃতি নিবেদনের পর আরতি করিয়া স্তোত্রপাঠ করিলেন।
এই সময়ে স্বামীজির শেষ ফটো (আলোকচিত্র) তুলিবার প্রস্তাব করা হইলে, শ্রীরাখাল মহারাজ নিষেধ করিয়া বলিলেন : “স্বামীজির কতো রকমের ভাল ফটো রয়েছে, এই বিষাদ মাখা ছবি সকলের হৃদয়কে বিদীর্ণ করবে।”
তাহার পরে শ্রীরাখাল মহারাজ প্রমুখ সন্ন্যাসীবৃন্দ ও ব্রহ্মচারিগণ স্বামীজির চরণে পুস্পাঞ্জলি দিলেন। অবশেষে স্বামীজির সহাধ্যায়ী বন্ধু হরমোহন মিত্র প্রভৃতি গৃহীভক্তবৃন্দ অঞ্জলি দিলেন। পরে স্বামীজির চরণতল অলক্তকে (আস্তায়) রঞ্জিত করিয়া তাহার পায়ের ছাপ লওয়া লইল। ভগিনী নিবেদিতাও একখানি নূতন রুমালে স্বামীজির চরণের ছাপ তুলিয়া লইলেন। একটি বড় বিকাশোন্মুখ ‘মার্শাল নীল’ জাতীয় গোলাপ ফুল চন্দনে চর্চিত করিয়া স্বামীজির চরণতলে বুলাইয়া আমি সেই স্মৃতিচিহ্নটি বুকপকেটে রাখিয়া দিলাম।
স্বামীজির পূজাদি কার্য সমাধানের পর শ্রীশরৎ মহারাজ ঐ পালঙ্কখানি বহন করিয়া যে স্থানে স্বামীজির দেহে অগ্নিসংস্কার করা হইবে সেখানে লইয়া যাইবার জন্য আমাদেরই চারিজনকে পুনরায় অনুমতি দিলেন। তাহার পরে উঁহারা সকলে শবানুগমন করিতে লাগিলেন।
সেইদিন পূর্বাহ্নে বৃষ্টিপাত হওয়াতে মঠের পিচ্ছিল চোরপুলি কাঁটায় পূর্ণ বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ ধীরে ধীরে সন্তর্পণে পার হইয়া আমরা পালঙ্কখানি চন্দনকাষ্ঠের চিতার উপরে স্থাপন করিলাম। সেই সময়ে কলিকাতা সিমলা পল্লী হইতে একখানিগাড়িকরিয়াস্বামীজিরকাকীমা এবং জ্ঞাতিভ্রাতাহাবুদত্তসপরিবারে আসিয়া কিছুক্ষণ উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন ও বিলাপ করিতে লাগিলেন।
তাহার পরে শ্রীশরত্মহারাজ উপস্থিত সকলকে বলিলেন:”তোমরা এক এক বাণ্ডিল পাকাটি আগুনে ধরিয়ে নিয়ে এই বেদীকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে শেষে খাটেরনীচে স্বামীজির পায়ের তলায় জ্বলন্ত আগুন রেখে প্রণাম কর।”
তাঁহার আদেশমত স্বামীজির শরীরকে চন্দন কাষ্ঠে প্রজ্বলিত অগ্নিতে আহুতি প্রদানের পর শোকসন্তপ্ত ভক্তগণ প্রজ্বলিত চিতাকে বেষ্টন করিয়া প্রস্তর মূর্তির ন্যায় বসিলেন। চিতাবহ্নি ক্রমে ক্রমে লেলিহ্যমান্ ঊর্ধ্বমুখী বহু জিহ্বা বিস্তার করিয়া ধূ ধূ করিয়া জ্বলিতে লাগিল। সেই সময়ে মহাকবি গিরিশচন্দ্র, বসুমতী’র উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক জলধর সেন, মাষ্টার মহাশয় (শ্রীম), অক্ষয়কুমার সেন (শাঁখচুন্নী মাষ্টার) প্রভৃতি গৃহীভক্তগণ বেলতলার সন্নিকটে রকের উপর বসিয়া এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখিতে লাগিলেন।
গিরিশবাবু ভগ্নহৃদয়ে আক্ষেপ করিয়া বলিলেন : “নরেন! কোথায় তুমি বেঁচে থেকে আমার কথা লোকের কাছে বলে ঠাকুরের মহিমা প্রচার করবে, কিন্তু সে সাধে পোড়া বিধি হোল বাদী, আমি বুড়ো বেঁচে রইলুম তোমার এই দৃশ্য দেখবার জন্যে? তুমি তো ঠাকুরের ছেলে, ঠাকুরের কোলে গিয়ে উঠলে, বল দেখি এখানে আমাদের কি দশায় ফেলে অকালে চলে গেলে? নিশ্চয়ই আমাদের কপাল ভেঙেছে।”
ইহা শুনিয়া ভগিনী নিবেদিতা শোকোচ্ছ্বাস চাপিয়া রাখিতে পারিলেন না। তিনি জ্বলন্ত চিতার সন্নিকটে চারিপার্শ্বে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন। পাছে তাহার গাউনে (পরিচ্ছদে) আগুন ধরিয়া যায় এই আশঙ্কায় মহারাজজী (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) কানাই মহারাজকে বলাতে, তিনি ভগিনীর হাত ধরিয়া তফাতে গঙ্গার ধারে লইয়া গিয়া বসাইলেন এবং কোনমতে। তাঁহাকে প্রবোধ দিতে লাগিলেন।
স্বামীজির নারায়ণী তনুখানির নিম্ন অর্ধাংশ অনুকূল বায়ুর হিল্লোলে সেই হোমাগ্নি মধ্যে অল্পক্ষণেই ভস্মে পরিণত হইল। কিন্তু আশ্চর্য, তাহার বুকে, মুখে এবং মস্তকের কেশে অগ্নিস্পর্শ না করাতে সেই মুখভঙ্গী, আয়ত নেত্রের দৃষ্টি কী সুন্দর দেখাইতে লাগিল!
এমন সময়ে জানি না কোন্ প্রেরণায় পরমহংসদেবের কোনো এক বিশিষ্ট গৃহীভক্তের মুখ হইতে অত্যন্ত মর্মান্তিক একটি মন্তব্য বাহির হইল। ইহা নিতান্তকঠোর ও পরিতাপের বিষয় বলিয়া লিপিবদ্ধ করা হইলনা। তাহা শ্রবণে সকলেই মর্মাহত হইলেন এবং স্বামীজির সন্ন্যাসী শিষ্য শ্রীনিশ্চয়ানন্দ উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, “যো কোই স্বামীজিকা শির’পর লাঠি মারেঙ্গে, উকো শির লাঠিসে হাম্ তোড়েঙ্গে, যেতনা কাঠ লাগে গাছ তোড়কে হাম্ আভি দেঙ্গে।” এই বলিয়া অদূরবর্তী এক প্রাচীন বৃক্ষে আরোহণ পূর্বক তিনি শাখা ছেদন করিয়া প্রচুর কাষ্ঠ সংগ্রহ করিবার পর জ্বলন্ত চিতার উপর তাহা সাজাইয়া স্বামীজির মুখোনি আবৃত করিয়া দিলেন।