একটা কঠিন সত্য এইসব প্রশ্নর ভিতর থেকে আজও উঁকি দেয়। এক সময় বিশ্বজোড়া আলোড়ন তুললেও স্বামী বিবেকানন্দকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে আমরা যথেষ্ট সময় নিয়েছি। যুগনায়ক বিবেকানন্দকে ভারতবন্দিত করে তোলার পিছনে সব চেয়ে বড় অবদান বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের। সন্ন্যাসী-সন্তানরা এই প্রতিষ্ঠানকে একশ বছর ধরে প্রাণবন্ত না রাখলে, স্বামী বিবেকানন্দ আজও এইভাবে স্মরণীয় থাকতেন কিনা সন্দেহ হয়।
.
স্বামীজির দেহাবসানের পরের দিনের বিবরণের জন্য আমরা মূলত নির্ভরশীল নিবেদিতার কয়েকটি চিঠি ও ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথের স্মৃতিকথার ওপর। মেজভাই মহেন্দ্রনাথ তখনও কলকাতায় ফিরে আসেননি।
আরও একজনের মূল্যবান অথচ বিষাদময় স্মৃতিচারণ সম্প্রতি ভক্তজনের নজরে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শীর নাম শ্রীচন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়। স্বামীজির দেহাবসানের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে বিশ্ববাণী পত্রিকায় (ভাদ্র ১৩৫৪) তিনি একটি স্মৃতিকথা লেখেন। তার সামান্য অংশ এখানে উদ্ধৃত করলে একালের পাঠকের কৌতূহল কিছুটা নিবৃত্ত হতে পারে।
“…আমাদের আহিরীটোলার বাটীতে স্বামীজির শিষ্য কানাই মহারাজ (স্বামী নির্ভয়ানন্দ) আসিয়া শোকসংবাদটি জানাইয়া গেলেন। তখন আমি কোনও দেবমন্দিরে ঠাকুরের সেবাপূজাদি কার্যে নিযুক্ত ছিলাম। ৯টার পূর্বে বাড়িতে ফিরিয়া দেখিলাম আমার জননী শোকবিহ্বল চিত্তে উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিতেছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন : “বাবা! তোদের সর্বনাশ হয়েছে–মঠের স্বামীজি আর নেই, দেহ রেখেছেন, আমাকে একবার তাঁকে দেখালি নি!” আমি বলিলাম : “মঠের সকল সাধুই ‘স্বামী, তুমি কোন্ স্বামীজির কথা বলছো? তুমি বোধ হয় ভুল শুনেছো”-”ওরে, কানাই ভোরে এসে খবর দিয়ে গেছে–বড় স্বামীজি কাল রাত ৯টায় শরীর ছেড়ে চলে গেছে। কানাই তোদের মঠে যেতে বলেছে।”
রোরুদ্যমান জননীকে আশ্বস্ত করিয়া বলিলাম : “সাধুর দেহত্যাগে শোক করতে নেই।” ঠিক সেই সময়ে বন্ধু নিবারণচন্দ্র (শ্রীশ্রীমার শিষ্য) উপস্থিত হওয়াতে সেদিন (৫ জুলাই শনিবার) আপিসে না যাইয়া স্বামীজিকে শেষ দর্শন করিবার জন্য আমি ভক্ত নিবারণকে এবং আমার কনিষ্ঠ সহোদর শ্রীমান দুলালশশীকে সঙ্গে লইয়া আহিরীটোলার ঘাটে নৌকায় গঙ্গা পার হইয়া সালিখা ঘুসুড়ির পথে পদব্রজে তিনজনে বেলা দশটায় বেলুড় মঠে গিয়া পঁহুছিলাম।
তখন সামান্য বৃষ্টিপাত হইতেছিল। দেখিলাম পশ্চিম দিকে নীচেকার ছোট দালানে (বারান্দায়) পূজ্যপাদ শ্রীরাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) প্রমুখ কয়েক জন সন্ন্যাসী একখানি সুন্দর খাটে পুষ্পশয্যা রচনায় রত। আমাদের দেখিয়া শ্রীরাখাল মহারাজ কাঁদিয়া ফেলিলেন, তাহার বাক্যস্ফূর্তি হইল না–সিঁড়ির দিক দেখাইয়া উপরে যাইতে ইঙ্গিত করিলেন।
স্বামীজির ঘরে যাইয়া দেখিলাম–একখানি সুন্দর গালিচার উপর শয়ান তাঁহার দিব্যভাবদীপ্ত দেহ বিভূতি-বিভূষিত, মস্তক পুষ্প-কিরীট ভূষণে এবং সর্বাঙ্গ নবরঞ্জিত গৈরিকবসনে সুসজ্জিত; প্রসারিত দক্ষিণ হস্তের অঙ্গুলিতে রুদ্রাক্ষের জপমালাটি জড়িত এবং ধ্যানমগ্ন মহাদেবের ন্যায় অক্ষিতারা অন্তর্মুখী ও অর্ধনিমীলিত–দুই পার্শ্বে ধূপদানি হইতে ধূপের মধুর সৌরভে তাহার ঘরটি আমোদিত।
স্বামীজির বামদিকে ভগিনী নিবেদিতা অপূর্ণনেত্রে বসিয়া হাত-পাখার দ্বারা স্বামীজির মাথায় অনবরত বাতাস করিতেছেন আর অজস্র অশ্রুধারা তাঁহার গণ্ডদেশ বহিয়া ঝরিতেছে। স্বামীজির মস্তকটি পশ্চিমদিকে এবং দুখানি পা পূর্বদিকে গঙ্গাভিমুখে স্থাপিত। তাঁহার পদপ্রান্তে নন্দলাল ব্রহ্মচারী বিষাদ মৌনমুখে নীরবে বসিয়া রহিয়াছেন। আমরা তিনজনে মস্তক অবনত করিয়া স্বামীজির পাদপদ্ম স্পর্শ ও প্রণাম করিয়া সেখানে বসিলাম। স্পর্শ করিয়া অনুভব করিলাম স্বামীজির দেহবরফের মতনই ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে।
স্বামীজির দক্ষিণকরের অঙ্গুলিতে রুদ্রাক্ষের মালার দানাগুলিতে আমি গুরুদত্ত মন্ত্র জপ করিয়া লইলাম। ইতিমধ্যে কলিকাতা এবং অন্যান্য স্থান হইতে সমাগত বহু ভদ্রলোক এবং ভক্ত উপরের ঘরে আসিয়া স্বামীজিকে শেষ দর্শন এবং প্রণামাদি করিয়া একে একে চলিয়া গেলেন–রহিলাম কেবল আমরা তিনজন, ব্রহ্মচারী নন্দদুলাল এবং ভগিনী নিবেদিতা।
আমার জপ সাঙ্গ হইলে, ভগিনী নিবেদিতা আমাকে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিলেন : “Can you sing, my friend? Would you mind singing those songs which our Thakur used to sing?” ওই বিষয়ে আমার। অক্ষমতা জানাইলে, ভগিনী পুনরায় অনুরোধ করেন : “will you please request your friend on my behalf?”
তখন বন্ধু নিবারণচন্দ্র সুমধুর স্বরে কয়েকখানি গান প্রাণ খুলিয়া গাহিতে লাগিলেন : যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে’, ‘গয়াগঙ্গাপ্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায়’, ‘কে বলে শ্যামা আমার কালো, মা যদি কালো তবে কেন আমার হৃদয় করে আলো’, ‘মজলো আমার মন ভ্রমরা, শ্যামাপদ নীলকমলে’, ‘মন আমার কালী কালী বলনা, কালী কালী বললে পরে, কালের ভয় আর রবে না ইত্যাদি।…
বেলা প্রায় একটার সময় শ্রীশরৎ মহারাজ (স্বামী সারদানন্দ) দোতলায় স্বামীজির ঘরে আসিয়া আমাদের তিনজনকে এবং ব্রহ্মচারীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন : “বাবা! স্বামীজি চলে যাওয়াতে আমরা ভেঙে পড়েছি তামাদের বল টুটে গেছে। তোরা সকলে ধরাধরি করে স্বামীজির দেহখানি নীচে নামিয়ে আনতে পারবি?”