ডাক্তার মজুমদার দেখলেন, হৃদযন্ত্র বন্ধ। স্বামীজির দু’হাত অর্ধচন্দ্রাকারে সামনে-পিছনে ঘোরাতে বললেন। কৃত্রিম উপায়ে হার্ট সচল করবার সবরকম চেষ্টা চললো।
•১২.০০ : ডাক্তার জানালেন, না, স্বামীজি আর ইহলোকে নেই। হঠাৎ হার্ট বন্ধ হওয়াই দেহাবসানের কারণ।
বিবেকানন্দ ইহলোক ত্যাগ করেছেন ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিন বয়সে। তিনি কথা রেখেছেন, বলেছিলেন, আমি ৪০ দেখবো না।
দেহত্যাগের কিছুদিন আগে (২৮ মার্চ ১৯০২) নিবেদিতাকে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার যা দেবার ছিল তা দিয়ে ফেলেছি, এখন আমাকে যেতেই হবে।”
মহাপ্রস্থানের দুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, “এই বেলুড়ে যে আধ্যাত্মিক শক্তির ক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা দেড় হাজার বছর ধরে চলবে–তা একটা বিরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেবে।”
১লা জুলাই মঠের মাঠে ভ্রমণ করতে করতে গঙ্গার ধারে একটা জায়গা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে স্বামীজি গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, “আমার দেহ গেলে ঐখানে সৎকার করবি।”
পরের দিন সকাল : ৫ জুলাই : দেখা গেল চোখ দুটি জবাফুলের মতন রক্তবর্ণ, নাকমুখ দিয়ে অল্প রক্ত বেরুবার চিহ্ন রয়েছে। একজন ডাক্তার (ডাক্তার বিপিন ঘোষ) বললেন, সন্ন্যাস রোগে দেহত্যাগ হয়েছে। মহেন্দ্র ডাক্তার বলে গিয়েছিলেন, হৃৎক্রিয়া বন্ধ হওয়াই মহাপ্রয়াণের কারণ। অন্য ডাক্তাররা ভিন্ন মত প্রকাশ করলেন। “মাথার ভেতর কোনও শিরা ছিঁড়ে গিয়েছে।”
নিবেদিতা এলেন সকাল সাতটায়, দুপুর একটা পর্যন্ত একটানা পাখার হাওয়া করলেন। গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী দেবী খবর পেলেন সকালবেলায়। ভগ্নীপতিকে নিয়ে ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ বেলুড় মঠে এলেন, কিছুক্ষণ পরে বিলাপ করতে করতে দৌহিত্র ব্রজমোহন ঘোষকে নিয়ে জননী ভুবনেশ্বরী বেলুড়ে এলেন।
সাধুরা অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। চিতায় যখন আগুন দেওয়া হল তখন এলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। স্বামী নিরঞ্জনানন্দ বললেন, “নরেন চলে গেল।” গিরিশ বললেন, “চলে যাননি, দেহত্যাগ করলেন। এবার একটি সাদা রুমালে স্বামীজির লাল পদচিহ্ন তুলে নেওয়া হল।
নিবেদিতা একসময় গিরিশচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, মাকে ওরা বাড়ি পাঠিয়ে দিল কেন? ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “তাঁকে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়া হল।”
মঠভূমিতে পদচারণ করতে করতে বেলতলার নিকট দাঁড়িয়ে স্বামীজি একদিন বলেছিলেন, ঐ দেখ শরৎ, সামনেই ঠাকুরের চিতাস্মৃতি শ্মশান। আমার মনে হয় সমস্ত মঠভূমির মধ্যে এই স্থানটি সর্বোৎকৃষ্ট। সেই কথা মনে পড়ায় স্বামী সারদানন্দ দেহ সৎকারের জন্য ঐ জায়গাটি মননানীত করে স্থানীয় পৌরপ্রতিষ্ঠানের কর্তার নিকট চিঠি পাঠালেন এবং দু-তিনবার পত্রবিনিময়ের পর তার অনুমতি সংগ্রহ করতে পারলেন।
দাহকার্য সম্পন্ন হল সন্ধ্যা ছ’টার সময়। শেষ মুহূর্তেও কিছু বিস্ময়। নিবেদিতার পত্রাবলীতে যার উল্লেখ রয়েছে। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর অনুবাদ ব্যবহার করলাম। মিস ম্যাকলাউডকে লেখা নিবেদিতার চিঠি : “দুটোর সময়ে আমরা সকলে দাঁড়িয়ে আছি বিছানার উপর পাতা একটি বস্ত্রখণ্ডের দিকে তাকিয়ে আমি সারদানন্দকে জিজ্ঞেস করলাম–”ওটাও কি পোড়ানো হবে? ওটাই যে শেষবার আচার্যদেবকে আমি পরতে দেখেছি। সারদানন্দ সেই কাপড়টি আমাকে দিতে চাইলেন। আমি নিতে পারলাম না; শুধু বললাম, যদি মিস ম্যাকলাউডের জন্য পাড়ের কাছে। কোণের একটুকু কেটে নিতে পারি। কিন্তু ছুরি বা কাচি কিছুই ছিল না আমার কাছে। তাছাড়া কাজটা দেখতেও ভাল হত কিনা সন্দেহ। সুতরাং কিছু করলাম না। ছ’টার সময় হঠাৎ কে যেন আমার জামার হাতায় টান দিল। চোখ নামিয়ে দেখি–অগ্নি ও অঙ্গার থেকে অনেক দূরে আমার পায়ের কাছে উড়ে এসেছে ঠিক সেই দুই-তিন ইঞ্চি বস্ত্রখণ্ড–আমার প্রার্থিত। সমাধির ওপর পার থেকে সে যেন তার পত্র, তোমার জন্য।”
শেষ হল স্বামীজির মহাপ্রয়াণপর্বের অতি সংক্ষিপ্ত কথাসংগ্রহ।
*
শতাব্দীর দূরত্বকে সমীহ করেও কয়েকটি প্রশ্ন মনের মধ্য থেকে মুছে ফেলতে এখনও কষ্ট হয়।
• স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটি কেন মঠপ্রাঙ্গণে স্বামীজির শেষকৃত্যের অনুমতি দিতে প্রাথমিক ভাবে বিলম্ব করেছিলেন? এল। দুজনেই নিন্দন হাইকোর্ট জজকে
• শ্রীরামকৃষ্ণের ডেথ সার্টিফিকেট অনেকেই দেখেছেন, কিন্তু বিবেকানন্দের ডেথ সার্টিফিকেট কেউ দেখেছেন কি?
• বিশ্ববন্দিত পুরুষ–সন্ধ্যায় দেহাবসান হল, কিন্তু পরের দিনের কলকাতার সংবাদপত্রে খবরটা ছাপা হল না কেন?
• তিরোধানের পরে বিবেকানন্দ স্মরণসভার দু’জন হাইকোর্ট জজকে সভাপতিত্বের অনুরোধ করা হয়েছিল। দু’জনেই নিন্দাসূচক মন্তব্য করে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। একজন তো বলেছিলেন, হিন্দু রাজা দেশ শাসন করলে বিবেকানন্দকে ফাঁসি দেওয়া হত। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তার স্মৃতিকথায় এব্যাপারে চাপা দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
• স্বামীজির সমাধিস্থলে ছোট্ট একটি মন্দির তৈরির জন্য অতি সামান্য অর্থ সংগ্রহ করাও সহজ হয়নি কেন? জেনে রাখা ভাল, সামান্য এই কাজটির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে মঠ কর্তৃপক্ষের সময় লেগেছিল পুরো বাইশ বছর। মন্দিরের কাজ শুরু হয় জানুয়ারি ১৯০৭, প্রতিষ্ঠাকার্য সম্পন্ন হয় ২ জানুয়ারি ১৯২৪।