এর আগে ৭ এপ্রিল মহানন্দ কবিরাজ রোগী দেখে মাছ, তেল ও নুন খেতে অনুমতি দিলেন। এরপর জুন মাসের শেষের দিকে কবিরাজী চিকিৎসার ওপর পূর্ণ নির্ভর না করে বরানগরের ডাঃ মহেন্দ্রনাথ মজুমদারকে ডাকা হয়।
ইতিমধ্যে এপ্রিলের একদিনে সবার আড়ালে অনুরাগিনী জোসেফিন ম্যাকলাউডকে স্বামীজি বললেন, “জগতে আমার কিছুই নেই; নিজের বলতে আমার এক কানাকড়িও নেই। আমাকে যখন যা কেউ দিয়েছে তা সবই আমি বিলিয়ে দিয়েছি।”
শুক্রবার, ৪ জুলাই ১৯০২। শেষের সেই দিনের হৃদয়গ্রাহী ছবি কয়েকটি বইতেই অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে অবিস্মরণীয়ভাবে আঁকা হয়েছে।
এই প্রচেষ্টার শুরুতে স্বয়ং নিবেদিতা, তারপর রামকৃষ্ণে নিবেদিতপ্রাণ সন্ন্যাসীলেখকবৃন্দ।
তারই একটি নিতান্ত সংক্ষিপ্তসার এইখানে দেবার চেষ্টা করা যাক ব্যস্ত পাঠক-পাঠিকাদের একনজরে অবগতির জন্যে। স্বামী প্রেমানন্দর এক চিঠি থেকে : “কিছুদিন হতে বৈরাগ্যের ভাব খুব প্রবল দেখতাম…জিজ্ঞেস করতেন, হারে ঠাকুর কোন দুটি গান শেষে শুনতে ভালবাসতেন বলে ‘ভুবন ভুলাইলি মা ভবমোহিনী’ ও ‘কবে সমাধি হব শ্যামাচরণে এই গানগুলি গাইতেন..শেষের দিনেও বেদ সংক্রান্ত পুস্তক আনাইবার জন্য পুণা ও বোম্বাই নগরে তিনখানি চিঠি লেখা হয়।”
• খুব সকালে : ঘুম থেকে উঠে, স্বামীজি মন্দিরে গেলেন উপাসনার জন্য। তার মধ্যে অসুস্থতার কোনও লক্ষণ নেই।
• ব্রেকফাস্টের সময় : সকলের সঙ্গে বেশ হাসি ঠাট্টা হল। যেমন গরম দুধ, ফলাদি খান সেইরূপ খেলেন ও স্বামী প্রেমানন্দকে খাওয়াবার জন্যে কত আগ্রহ করলেন। চা কফি যেরকম খেয়ে থাকেন তাই খেলেন। গঙ্গার একটি ইলিশ মাছ এ বছর প্রথম কেনা হল, তার দাম নিয়ে স্বামী প্রেমানন্দের সঙ্গে কত রহস্য হল! একজন বাঙালকে বললেন, তোরা নতুন ইলিশ পেলে নাকি পুজো করিস? কী দিয়ে পুজো করতে হয় কর।
• প্রভাতী ভ্রমণ : বেড়াতে বেড়াতে স্বামী প্রেমানন্দকে বললেন, আমায় কেন নকল করবি? ঠাকুর নকল কত্তে বারণ করতেন। আমার মতন উড়নচড়ে হবি নে।
• সকাল ৮.৩০ : প্রেমানন্দকে বললেন, “আমার আসন ঠাকুরের শয়নঘরে করে চারিদিকের দরজা বন্ধ করে দে।” ঠাকুরঘরে স্বামীজির ধ্যান শুরু।
• সকাল ১১টা : ধ্যানভঙ্গ। স্বামীজি গুন গুন করে গাইছেন–মা কি আমার কালো, কালোরূপা এলোকেশী, হৃদিপদ্ম করে আলো। ধ্যানান্তে স্বামীজি নিজের হাতে ঠাকুরের বিছানা ঝেড়ে দিলেন।
• সকাল ১১.৩০ : নিজের ঘরে একলা না খেয়ে সকলের সঙ্গে একত্র মধ্যাহ্নভোজন–ইলিশ মাছের ঝোল, ভাজা, অম্বল ইত্যাদি দিয়ে ভাত খেলেন। “একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি কষ্টে!”
• দুপুর ১২.৩০ : ১৫/২০ মিনিট ঘুমিয়ে নিলেন স্বামীজি। স্বামী প্রেমানন্দকে বললেন, “চল পড়িগে। সন্ন্যাসী হয়ে দিবানিদ্রা পাপ।”
“আমার আজ ঘুম হলো না। একটু ধ্যান করে মাথাটা খুব ধরেছে–ব্রেন উইক হয়েছে দেখছি।”
• অপরাহু ১-৪ : অন্যদিনের তুলনায় ঘণ্টা দেড়েক আগে লাইব্রেরি ঘরে সাধু-ব্রহ্মচারীদের ক্লাস নিলেন স্বামীজি। তার পড়ানোর বিষয় : পাণিনী ব্যাকরণ। ক্লাস নেওয়ার পরে স্বামীজি একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লেন।
• বিকাল ৪টা : এক কাপ গরম দুধ খেয়ে বেড়াতে বেরোলেন। স্বামী প্রেমানন্দকে সঙ্গী করে বেলুড় বাজার পর্যন্ত গেলেন। প্রায় দু’মাইল ভ্রমণ ইদানীং এতটা যেতেন না।
• বিকাল ৫ : স্বামীজি মঠে ফিরলেন। আমগাছের তলায় বেঞ্চে বসে বললেন, আজ শরীর যেমন সুস্থ, এমন অনেকদিন বোধ করি না। তামাক খেয়ে পায়খানা থেকে এসে বললেন, আমার শরীর আজ খুব ভাল আছে। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের পিতৃদেব শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে কিছু কথা বললেন।
• সন্ধ্যা ৬.৩০ : কয়েকজন সন্ন্যাসী চা খাচ্ছিলেন, স্বামীজি নিজে এককাপ চা চাইলেন।
• সন্ধ্যা ৭.০০ : সন্ধ্যারতির ঘণ্টা বাজতেই স্বামীজি নিজের ঘরে চলে গেলেন। সঙ্গে বাঙাল ব্রজেন্দ্র। “আমাকে দু’ছড়া মালা দে, যা, বাইরে গিয়ে জপধ্যান কর। না ডাকলে আসবি না।” স্বামীজি জপে বসলেন দক্ষিণেশ্বরের দিকে মুখ করে।
• সন্ধ্যা ৭.৪৫ : স্বামীজি ব্রজেন্দ্রকে বললেন, “গরম বোধ হচ্ছে। জানলা খুলে দাও।” মেঝের বিছানায় বিবেকানন্দ শুয়ে পড়লেন, হাতে জপমালা। একটু পরে বললেন, “আর বাতাস করতে হবে না। একটু পা টিপে দে।”
• রাত ৯.০০ : এতক্ষণ স্বামীজি চিৎ হয়েছিলেন, এবার বাঁপাশে ফিরলেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে তার ডান হাত একটু কাপল। স্বামীজির কপালে ঘামের ফেঁটা। এবার শিশুর মতন কান্না।
• রাত ৯.০২ থেকে ৯.১০: গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মিনিট দুই স্থির, আবার গভীর দীর্ঘশ্বাস। মাথা নড়ে উঠল, মাথা বালিশ থেকে পড়ে গেল। চোখ স্থির, মুখে অপূর্ব জ্যোতি ও হাসি।
• রাত ৯.৩০ : সবাই ছুটে এলেন, ভাবলেন সমাধি হয়েছে। স্বামী বোধানন্দ নাড়ি ধরে কিছুক্ষণ দেখে, দাঁড়িয়ে উঠে কেঁদে ফেললেন। একজন বললেন, “যাও ছুটে যাও মহেন্দ্র ডাক্তারকে ডেকে আনো।” ডাক্তার মজুমদার থাকেন নদীর ওপারে বরাহনগরে। প্রেমানন্দ ও নিশ্চয়ানন্দ সমাধি ভাঙাবার জন্য কানে রামকৃষ্ণ নাম শোনাতে লাগলেন।
• রাত ১০.৩০ : ডাক্তার মজুমদার, স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও সারদানন্দ প্রায় এক সঙ্গে বেলুড়ে উপস্থিত হলেন। এলেন বৈকুণ্ঠ সান্যাল।