স্বামীজির অতিপ্রিয় সারমেয় বাঘা নিতান্ত সাধারণ কুকুর নয়, সে মঠের জনসংযোগ অধিকর্তার দায়িত্ব পালন করত, বিশিষ্ট অতিথিদের মঠের গেট থেকে কর্তৃপক্ষের কাছে এনে দিত। এ-বিষয়ে শঙ্করীপ্রসাদ বসু যে বিবরণ সংগ্রহ করে দিয়েছেন তা পাঠকদের আনন্দ দেবে।
স্বামীজির শেষদিনগুলিতে বুঝতে গেলে বাঘাকেও জানা দরকার। “একবার অত্যধিক দুষ্টুমির জন্য তাহাকে গঙ্গার পরপারে নির্বাসনে যাইতে হয়। কিন্তু বাঘা এই ব্যবস্থা মানিয়া লইতে সম্মত ছিল না–সে মঠকে ভালবাসিত, বিশেষত স্বামীজিকে ছাড়িয়া থাকিতে পারিত না। সারাদিন অতীব দুঃখে কাটাইয়া সে সন্ধ্যাকালে এক ফন্দি আঁটিল এবং খেয়া নৌকায় উঠিয়া বসিল। নৌকার মাঝি ও আরোহীরা তাহাকে তাড়াইতে চেষ্টা করিলেও সেনামিলনা,বরং দন্ত বাহির করিয়া ও গর্জন করিয়া ভয় দেখাইতে লাগিল।…এপারে আসিয়া সে রাত্রিটা এদিক-ওদিক লুকাইয়া কাটাইল। ভোর চারিটায় স্বামীজি স্নানাগারে যাইতেছেন, এমন সময় পায়ে কী একটা ঠেকায় তিনি চমকিয়া উঠিলেন ও চাহিয়া দেখিলেন বাঘা! বাঘা তাহার পায়ে লুটাইয়া মিনতিপূর্ণ কণ্ঠে ক্ষমাভিক্ষা ও পুনঃপ্রবেশাধিকার ভিক্ষা করিতে লাগিল।…স্বামীজি তাহার পিঠ চাপড়াইয়া আদর করিলেন ও আশ্বাস দিলেন, অধিকন্তু সকলকে বলিয়া দিলেন, বাঘা যাহাই করুক, আর তাহাকে তাড়ানো চলিবে না।”
স্বামী অখণ্ডানন্দর স্মৃতি থেকে আমরা স্বামীজির দেহাবসানের পরে পশুশালার শেষ পরিণতির কিছু দুঃখজনক খবরও পাই। অন্য কোথাও এই বিবরণ আমার চোখে পড়েনি। স্বামী অখণ্ডানন্দ লিখেছেন, “আশ্চর্যের বিষয়, স্বামীজির দেহরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভক্ত পশুপাখী সব মরে যায়। তিনি যাকে যা দিয়ে গিয়েছিলেন, তার একটিও বেশিদিন বাঁচেনি। ভক্তেরা বলেন, তারা সব উদ্ধার হয়ে গেল।”
স্বামীজির দেহাবসানের পর খোকা মহারাজ (স্বামী সুবোধানন্দ) কয়েকটি পশুপক্ষী স্বামী অখণ্ডানন্দকে দিয়েছিলেন। শুনুন তাদের শেষ পরিণতির কথা। “একটি বেড়াল স্বামীজির পায়রাটিকে লুকিয়ে লুকিয়ে খায়। অমূল্য মহারাজ (স্বামী শঙ্করানন্দ) সেইসময় আশ্রমে ছিলেন। তিনি বিড়ালটিকে এমন ঘুষি মেরেছিলেন যে তাঁর হাত থেতলে গিয়েছিল।”
একমাত্র প্রিয় বাঘাই অপেক্ষাকৃত দীর্ঘজীবী হয়েছিল। স্বামীজির লীলাসংবরণের অনেককাল পরে বাঘার মৃত্যু হইলে তাহার দেহ গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হইল। জোয়ারের সময় সে শরীর ভাসিয়া চলিয়া গেলেও ভাটার সময় সকলে সবিস্ময়ে দেখিলেন, উহা মঠের সীমানার মধ্যেই গঙ্গার পলিমাটির উপর পড়িয়া আছে। ইহাতে মঠের প্রতি বাঘার প্রাণের টানের পরিচয় পাইয়া মঠবাসী একজন ব্রহ্মচারী অপরদের অনুমতিক্রমে ওই দেহ ওই স্থানেই সমাধিস্থ করিলেন।”
ডায়াবিটিস ধরা পড়ার সামান্য কিছুদিনের মধ্যে স্বামীজির শরীর কীভাবে ভেঙে পড়ে তার নানা ইঙ্গিত ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন চিঠিপত্রে এবং নানা স্মৃতিকথায়। মহাসমাধির কিছুদিন আগে কলকাতার বলরাম বসুর বাড়িতে সেকালের একজন প্রখ্যাত চিকিৎসককে ডাকা হয়েছিল স্বামীজিকে দেখতে। বিভিন্ন চিকিৎসায় স্বামীজি তখন যে কতখানি ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বড় ডাক্তার সম্পর্কে তার মন্তব্যে। তিনি বলেন, “কী ছাই জানে! দু’চারখানা বই পড়ে ভাবে–আমরা সব মেরে দিয়েছি। আমরা সব জানি। আমরা সব বুঝি।”
দেহত্যাগের এক সপ্তাহ আগে উত্তর কলকাতার বাগবাজারে শিষ্য অসীম বসুর সঙ্গে স্বামীজির দেখা হলো। শিষ্যের বাড়ির সামনে দিয়েই যাচ্ছিলেন স্বামীজি। অসীম বসু জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছেন?” স্বামীজি বললেন, “আরে তুমিও যেমন। ডাক্তার বদ্যিতে তো অনেক কথাই বলে। কিন্তু আমার মৃত্যুরোগ। তারা কী করবে?”
.
এই সময়ের বিবেকানন্দর আর একটা ছবি : “কখনও কখনও তিনি কেবলমাত্র কৌপীন পরিহিত হয়ে মঠের চতুর্দিকে ভ্রমণ করতেন। অথবা একটা সুদীর্ঘ আলখাল্লায় দেহ আবৃত করে পল্লীর নিভৃতপথে একাকী বিচরণ করতেন।”..আবার কখনও বইয়ের পাতা উল্টোতেন বা ছবি দেখতেন।
আর এক বিবেকানন্দকে তাঁর প্রিয় শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী একবার দেখেছিলেন নদীর অপর পারে আহিরীটোলা ঘাটে। স্বামীজির বাঁহাতে শালপাতার ঠোঙায় চানাচুর ভাজা, বালকের মতন খেতে খেতে ঘাটের দিকে চলেছেন। শিষ্যকে তিনি বললেন, “চল, তুই মঠে যাবি? চারটি চানাচুর ভাজা খা না, বেশ নুন-ঝাল আছে।”
*
সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের শেষ দিনটিকে তার শ্রদ্ধেয় জীবনীকাররা মহামুক্তির দিন বলে বর্ণনা করেছেন। তার কয়েকদিন আগেও কিছু অবিস্মরণীয় এবং কিছু কৌতুকময় ঘটনা ঘটেছে যার বিস্তারিত বিবরণ অবশ্যপাঠ্য। সিস্টার নিবেদিতার এই কয়েকদিনের বর্ণনা রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাহিত্যের মহামূল্যবান সম্পদ।
এই পর্বে স্বামীজি তার পৈত্রিক বাড়ি নিয়ে সমস্যার একটা সমাধান করতে পেরে নিজেকে দায়মুক্ত মনে করেছিলেন। নিবেদিতাকে একাদশীর দিনে পরম যত্নে খাইয়ে তার হাতে জল ঢেলে দিয়েছিলেন। একই সময়ে চলছিল প্রবল উৎসাহে মঠে পাঁউরুটি তৈরির পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
মৃত্যুর আগের দিন স্বামীজি দূত মারফত নিবেদিতার বাগবাজারের বাড়িতে নিজের তৈরি করা ব্রাউন ব্রেড পাঠিয়েছিলেন।